ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

শ্রমিক অসন্তোষ

শিল্পাঞ্চলে শুরু যৌথ বাহিনীর অভিযান

শিল্পাঞ্চলে শুরু যৌথ বাহিনীর অভিযান

.

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০১:০৯ | আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১২:২৭

শ্রমিক আন্দোলন ঘিরে অস্থিরতা চলছে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুরসহ কয়েকটি শিল্পাঞ্চলে। এসব এলাকায় কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে গতকাল সোমবার রাতে শুরু হয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও শিল্প পুলিশের যৌথ অভিযান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনে আরও কঠোর অবস্থানে যাবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আজ মঙ্গলবার কারখানা খোলা রাখতে মালিক কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। 

গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) এম জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর নেতাদের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকের আগে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সঙ্গেও বৈঠক করেন শিল্পোদ্যোক্তারা। 

বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, সরকার ও শিল্পোদ্যোক্তা উভয়েই মনে করেন, গত কয়েক দিন ধরে পোশাক কারখানায় যেসব হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে, তার পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র রয়েছে। সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ ও দেশকে অস্থিতিশীল করতে বহিরাগতরা কারখানায় হামলা করছে। এর সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকরা জড়িত নন।  
আগের দিনের মতো গতকাল সোমবারও সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী ও গাজীপুরের শতাধিক কারখানায় হামলার ঘটনা ঘটে। পরে ওইসব কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। টঙ্গীর বাটা শু কোম্পানি এবং নরসিংদীতে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কারখানাতেও হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এর আগে গত রোববার বিভিন্ন এলাকার কারখানায় হামলা-ভাঙচুর করে কিছু শ্রমিক। পরে অর্ধশতাধিক  কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। 

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কারখানায় হামলা-ভাঙচুরের পেছনে আসলে দেশি-বিদেশি চক্রের ষড়যন্ত্র রয়েছে। এটি জানা সত্ত্বেও এতদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেছে। কোনো রকম বল প্রয়োগ করা হয়নি। কিন্তু এর কোনো সুফল মেলেনি। দিন দিন হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা বেড়েছে। গতকাল পরিস্থিতি চরম আকার নেওয়ায় যৌথ বাহিনীর অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’ 

দেশি-বিদেশি যড়যন্ত্র দেখছেন উদ্যোক্তারা
শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সঙ্গে বৈঠকে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য শিল্প খাতে হামলা ও ভাঙচুরের জন্য দেশি-বিদেশি চক্রকে দায়ী করা হয়। এতে ‘বেকার যুবসংঘ’ নামে একটি সংগঠনের নাম আসে। 
বৈঠকে উদ্যোক্তাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি সমকালকে বলেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার ও উদ্যোক্তারা নিশ্চিত হয়েছেন 

যে, শ্রম অসন্তোষের পেছেন ষড়যন্ত্র রয়েছে। যারা আন্দোলন করছে, তারা কেউই শ্রমিক নয়, সবাই বহিরাগত।’ পুরুষ শ্রমিক বেশি নিয়োগের যে দাবি করা হচ্ছে, সেটি উদ্ভট বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আশুলিয়ায় শতাধিক কারখানায় ছুটি
আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষের জেরে গতকাল শতাধিক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। সকালে জামগড়া এলাকায় আইডিএস পোশাক কারখানার শ্রমিকরা হাজিরা দিয়ে ১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করে। কারখানা থেকে বেরিয়ে তারা মহাসড়কে অবস্থান নেয়। এ সময় ওই এলাকার অলিগলি থেকে বহিরাগতরা লাঠিসোটা নিয়ে এসে শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দেয়। বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তারা জামগড়া, নরসিংহপুর, জিরাব ঘোষবাগ ও জিরানী এলাকার কারখানায় গিয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং প্রধান ফটকে ভাঙচুর চালায়। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পাঞ্চলের শতাধিক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। 
এদিকে সকাল ৮টা থেকে আশুলিয়ার ডিইপিজেড এলাকা, নবীনগর-চন্দ্রা ও বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে শ্রমিকরা। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় সড়কের দু’পাশের কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। পলাশবাড়ী, বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের নিশ্চিন্তপুর, জামগড়া, নরসিংহপুর এলাকার বিভিন্ন কারখানার সামনে জড়ো হয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। বেশ কিছু লোক জামগড়া এলাকার ‘দি রোজ’ কারখানায় ইটপাটকেল ছোড়ে। পরে তারা আইডিএস কারখানায় ইটপাটকেল ছোড়ে। 
শিল্প পুলিশ-১ এর সুপার মো. সারোয়ার আলম জানান, ডিইপিজেড এলাকায় কয়েক দিন ধরে চাকরির দাবিতে আন্দোলন করছে বেকার শ্রমিকরা। তাদের আরও কিছু দাবি রয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের অবরোধ তুলে দেওয়া হয়েছে। 

মহাসড়ক অবরোধ
বিভিন্ন পোশাক কারখানায় পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের দাবিতে গাজীপুরে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ হয়েছে। ভোগড়া বাইপাস এলাকায় লাঠি নিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে কিছু মানুষ। এতে সড়কের দুই পাশে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অবরোধকারীরা অভিযোগ করে, গাজীপুরের বেশকিছু পোশাক কারখানায় পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয় না। কোনো কোনো কারখানায় আবার নারী শ্রমিকের তদবিরে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। 
বর্ষা সিনেমা হলের সামনে বিভিন্ন কারখানায় নিয়োগ থেকে বাদ পড়া লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে বিক্ষোভ করে। এক পর্যায়ে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বেশকিছু যানবাহন ভাঙচুর করে। গাজীপুর মহানগরের বাসন থানার ওসি মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, শ্রমিকদের দাবি অনেকটা এলোমেলো। কেউ বলছে, তারা বেকার; তাদের চাকরি দেওয়া হোক। কেউ বলছে, নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য করা হয়।

টঙ্গীতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া
সকাল সাড়ে ৯টায় বহিরাগতরা বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলনে যোগ দিতে চাপ দেয়। তবে কাজ ফেলে আন্দোলনে যেতে রাজি হয়নি শ্রমিকরা। এতে বহিরাগতরা কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর চালায়। এ সময় কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে বহিরাগতদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভকারীরা জানায়, তারা চাকরিতে বৈষম্য ও পুরুষ শ্রমিকদের নিয়োগে অগ্রাধিকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। তাদের দাবি মেনে নেওয়া না পর্যন্ত কারখানায় কোনো শ্রমিককে ঢুকতে দেওয়া হবে না।

বাটা শু শ্রমিকদের বিক্ষোভ
গাজীপুরের টঙ্গীতে চাকরি স্থায়ীকরণ, বেতন বাড়ানো, পারিবারিক চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধিসহ ৮ দাবিতে বাটা শু বাংলাদেশ লিমিটেডের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছে। গতকাল সকাল ৯টা থেকে টঙ্গী বাজার এলাকায় বাটা শুর শ্রমিকরা কারখানার সামনে এ বিক্ষোভ করে। বাটা শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো সংস্কার; শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক ১৫ হাজার টাকা বেসিক বেতন ধরে সব সুবিধা বহাল রাখতে হবে; সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করলে ৩ ঘণ্টা ওভারটাইম এবং ডিএ বিল দিতে হবে। প্রতিবছর ২০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি করতে হবে। ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বেতন বৃদ্ধির হারে বৈষম্য করা যাবে না। সব শ্রমিকের ফ্যামিলির চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে। প্রতিবছর ঈদ বোনাস মাসিক মোট বেতনের সমপরিমাণ দিতে হবে। 

প্রাণ-আরএফএলে কাজ শুরু
নরসিংদীর পলাশ উপজেলার বাগপাড়া কারখানার আন্দোলনরত শ্রমিকদের দাবি মেনে কাজে ফিরিয়েছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। গতকাল ভোর ৫টা থেকে পাঁচ শতাধিক শ্রমিক বাগপাড়ায় অবস্থিত প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক কারখানার ভেতরে আন্দোলন শুরু করে। বেতন-বোনাস, ইনক্রিমেন্ট, ওভারটাইম বৃদ্ধি এবং আন্দোলনরতদের চাকরি থেকে বাদ না দেওয়াসহ ৩০ দফা দাবি জানায় তারা। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের দাবিগুলোর বিষয়ে আলোচনা করেন কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান। পরে তিনি শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন। এর পর সকাল ৭টায় আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দেয় শ্রমিকরা। 
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, সাভার এবং গাজীপুর, টঙ্গী ও পলাশ প্রতিনিধি)
 


 

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×