রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লটের মালিক আয়া-গাড়িচালক

ছবি: ফাইল
অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০৪:৩৩
দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এমন কেউ পেতে পারেন রাজধানীতে প্লট। এর জন্য আছে রাজউকের একটি ধারা। রাজধানীতে থাকার মতো নিজস্ব জায়গা নেই এমন কেউ ওই ধারা অনুযায়ী আবেদন করলে রাজনৈতিক বিবেচনায় পেতে পারেন জমি। তবে এসব নিয়ম শুধু কাগজকলমেই।
রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মী-অনুসারী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মালি, আয়া, গাড়িচালকও। অনৈতিকভাবে বরাদ্দ দেওয়া এমন দেড় হাজারের মতো প্লটের তালিকা হয়েছে। এগুলো বাতিল করতে চায় সরকার।
প্লট বরাদ্দ বিধিমালার ১৩/ক ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কোনো ব্যক্তির রাজধানীতে নিজস্ব থাকার মতো জায়গা না থাকলে সরকার মনে করলে তাঁকে একটি প্লট বরাদ্দ দিতে পারে।’ এ ধারার অপব্যবহার করে অনেক প্লট বরাদ্দ হয়েছে বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ উঠছে।
গত সাড়ে ১৫ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বরাদ্দ দেওয়া প্লট বাতিল করতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজউক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পছন্দের ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে রাজউক চেয়ারম্যানদের কাছে চিঠি পাঠাতেন। তখন তড়িঘড়ি করে সুবিধাজনক স্থানে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হতো। একই ধারায় শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্য পূর্বাচলে ছয়টি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন।
রাজউক সূত্র জানায়, এই ধারার সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকসহ পছন্দের লোকদের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্লটপ্রাপ্তদের চারটি ক্যাটেগরি করে তালিকা করা হচ্ছে। প্রথম ক্যাটেগরিতে রয়েছেন যারা জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন তারা। দ্বিতীয় তালিকায় রয়েছেন যারা কিস্তির পুরো টাকা পরিশোধ করলেও রেজিস্ট্রি করেননি। তৃতীয় তালিকায় আছেন বরাদ্দ পেয়ে যারা কিস্তির পুরো টাকা পরিশোধ করেননি। অন্য তালিকায় থাকছেন যারা বরাদ্দ পেয়ে কোনো কিস্তি পরিশোধ করেননি।
পূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ বিষয়ে আলোচনার জন্য সম্প্রতি রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমানকে মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান চেয়ারম্যানের কাছে এ ধরনের সব প্লটের বরাদ্দ বাতিলের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। চেয়ারম্যান বলেছেন, এতে কোনো আইনি জটিলতা তৈরি হবে কিনা, সেটা ভেবে দেখা প্রয়োজন। তখন উপদেষ্টা বলেন, যেগুলো রেজিস্ট্রি হয়েছে, সেগুলো ছাড়া বাকি সব প্লটের বরাদ্দ প্রয়োজনে বাতিল করা হবে। এর কারণ স্বচ্ছতা ও নিয়ম অনুসরণ না করে দলীয় বিবেচনায় এসব প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যানকে এ ধরনের প্লটগুলোর তালিকা প্রণয়নের কথা বলা হয়।
গত মঙ্গলবার পর্যন্ত উত্তরা মডেল টাউনে ২৪০টি, কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে ১৯৭ ও পূর্বাচলে ১ হাজার ২৬টি প্লটের তালিকা করেছে রাজউক। এসব প্লটের আকার তিন কাঠা, পাঁচ কাঠা, সাড়ে সাত কাঠা ও ১০ কাঠা। এর মধ্যে কিছু প্লটে অবকাঠামো গড়া হয়েছে। আবার কিছু প্লট বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তি অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।
বিক্রি করা হয়েছে এমন প্লট কীভাবে বাতিল করা হবে– জানতে চাইলে রাজউকের আইনজীবী ইমাম হাসান সমকালকে বলেন, ১৩/ক ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র যাকে যোগ্য মনে করবে, তাঁকে প্লট দিতে পারবে। তবে তাঁর রাজধানীতে অন্য কোনো জমি থাকলে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না। এসব বরাদ্দ রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তেই হয়েছে। রাজউকের প্লট বাতিলের নিয়মে বলা আছে, যদি কারও একাধিক প্লট থাকে, তাহলে একটি ছাড়া অন্যগুলো বাতিল হবে। এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, পরিবারের নির্ভরশীলদের কারও নামে প্লট থাকলে তিনি বরাদ্দ পাবেন না বা পেলেও বাতিল হবে। এখন এসব প্লট বাতিল করতে হলে সরকার আইন সংশোধন করবে কিনা, তা বলা যাচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর বকশীবাজারের এক বাসিন্দা সমকালকে জানান, এক সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন তিনি। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করে ঝিলমিল প্রকল্পে পাঁচ কাঠার প্লট পেয়েছিলেন। কিস্তির টাকা পরিশোধও করেছেন। দীর্ঘদিন বেকার থাকায় প্লটটি রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার মতো অর্থ তাঁর ছিল না। এই প্লটটিই তাঁর একমাত্র সম্বল। এটা বাতিল করলে তাঁর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। জানা গেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাড়িচালক, পিয়ন, মালীদের মধ্যে প্লট পেয়েছেন সাইদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, নুরুল ইসলাম, মতিউর রহমান, মাহবুব হোসেন, বোরহান উদ্দিনসহ অনেকেই।
দীর্ঘদিন ধরেই প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে হয়ে আসছে ১৩/ক ধারার অপব্যবহার। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও হয়েছে নানা অনিয়ম।
রাজউকের পরিচালক (আইন) শীলাবৃত কর্মকার বলেন, সরকার চাইলে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এখন দেখতে হবে কোন আইনে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, আর কোন আইনের ভিত্তিতে এটা বাতিল করা হয়।
এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের প্লটের তালিকা করতে বলা হয়েছে। আমরা এ নিয়ে কাজ করছি। পুরো কাজ শেষ হয়নি। এখন বাতিল করা না করা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে এসব প্লট বাতিলের অভিপ্রায় সরকারের রয়েছে বলে উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন।’ এ বিষয়ে জানতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টার সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
- বিষয় :
- রাজউক