ঢাকা শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ

সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দাপটে দিশেহারা সবাই

সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দাপটে দিশেহারা সবাই

ফাইল ছবি

 ইয়াসির আরাফাত

প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৩ | আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৭:৪১

সরকারের এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলো মনিটরিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ সেখানকার কর্মকর্তারা। দেশের অধিকাংশ অফিসে বিগত সরকারের আমলে সুবিধাজনক স্থানে থাকা কর্মকর্তারা এখন বেকায়দায় থাকলেও আইএমইডিতে চলছে তাদের দাপট। তাদেরই একজন সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ফয়সাল কবীর। তিনি বদলিযোগ্য পদে চাকরি করলেও টানা ৯ বছর আইএমইডির সচিব দপ্তরে কর্মরত। দশম গ্রেডের একজন কর্মকর্তা হলেও বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আড়ালে তাঁকে ‘সেকেন্ড সেক্রেটারি’ বলে ডাকেন। কারণ হিসেবে জানা যায়, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ, কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলি কিংবা বিভাগের নিজস্ব কেনাকাটা সবকিছুতেই থাকে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। অধিকারভুক্ত না হয়েও নিয়মিত ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড থাকা গাড়ি ব্যবহার করেন তিনি। 

অভিযোগ রয়েছে, প্রাপ্য না হয়েও ছুটির দিনে পরিবার-পরিজন নিয়ে এই গাড়ি ব্যবহার করেন এ কর্মকর্তা। এই গাড়ি ব্যবহার করে নিজ জেলা ময়মনসিংহেও বেড়াতে যান। সম্প্রতি কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণে যেতেও পুরো পরিবার নিয়ে তিনি এই গাড়ি ব্যবহার করেন। অথচ তাঁর সহকর্মীরা বাসে করে যান।
এ ছাড়া আইএমইডির বিভিন্ন ডেস্ক কর্মকর্তার কাছে অনৈতিক তদবির করেন ফয়সাল। কোনো কারণে এই তদবির না রাখলে সেই কর্মকর্তার ওপর খড়্গ নেমে আসে। তিন মাসের মাথায় দুই দফা অভ্যন্তরীণ বদলি হয়েছেন– এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন আইএমইডিতে।

সূত্র জানায়, ‘ফলাফলভিত্তিক পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতির কার্যকর ব্যবহারে আইএমইডির সক্ষমতা বৃদ্ধি (১ম সংশোধিত)’ শিরোনামে আইএমইডির নিজস্ব একটি প্রকল্প রয়েছে। দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে এই প্রকল্পে ফয়সাল কবীর ডেটা এন্ট্রি বা কন্ট্রোল সুপারভাইজারের দায়িত্বে রয়েছেন। বিভাগে এ পদে আরও চারজন সুপারভাইজার থাকলেও সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে এই পদটি বাগিয়ে নেন। প্রকল্পের ডেটা এন্ট্রি বা কন্ট্রোল সুপারভাইজার হলেও মূলত প্রকল্প পরিচালকের ভূমিকা পালন করেন তিনি। 

প্রকল্পের আওতায় ব্যবহৃত ছয়টি গাড়ির চালকরা তাঁর নির্দেশনা মেনে চলেন। আইএমইডির কর্মকর্তাদের প্রকল্প পরিদর্শনের জন্য প্রকল্পের আওতায় গাড়িগুলো কেনা হয়েছিল। শুধু গাড়ি নয়, প্রকল্প পরিচালনার সবদিকই দেখেন ফয়সাল। অভিযোগ রয়েছে, পঞ্চম গ্রেডের এক সিনিয়র প্রোগ্রামার প্রকল্পটির নামকাওয়াস্তে প্রকল্প পরিচালক। ফয়সাল তাঁকে যা বলেন, তিনি সেভাবেই চলেন। এর আগের প্রকল্প পরিচালক তাঁর কথা না শোনায় তাঁকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রকল্পটির আওতায় যে কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ পেতে হলেই তাঁকে কমিশন দিতে হয়। মাস চারেক আগে ‘ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (এমটিআই)’ এই বিভাগের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা সফরের কাজ পায়। কয়েক কোটি টাকার এই কাজে যে কোনো অংশের কাজ শেষ করতে এবং কাজ শেষে বিল তুলতে তাঁকে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া ফি বছর রাজস্ব খাতের আওতায় আইএমইডিতে যে ৭৬টি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়, তার পুরোটাই থাকে তাঁর নিয়ন্ত্রণে। এই খাত থেকে বার্ষিক কয়েক কোটি টাকা অবৈধ আয় রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া শিক্ষা ও সামাজিক সেক্টরের ডিএলআই খাতের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ থেকেও ফয়সালের আয় উল্লেখযোগ্য। আইএমইডির ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি, তদন্ত করে ফয়সালের সব অনৈতিক কর্মকাণ্ড যেন প্রকাশ করা হয়।

সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে তিনি দায়িত্বে থাকায় গোপনীয় অনেক নথি এবং জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের অনেক একান্ত বিষয় তাঁর জানার সুযোগ ঘটে। আর এই সুযোগের অপব্যবহার করে বিভিন্ন সময় বিভাগের বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ব্ল্যাকমেইল করে নিজস্ব একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন ফয়সাল।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক এক প্রভাবশালী সচিবের আমলে তাঁর দৌরাত্ম্যে সবাই তটস্থ থাকতেন। ওই সময় ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই প্রকল্পের সময় বাড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট রেট ধরা থাকত। এক বছরে গড়ে তিন শতাধিক প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো ছাড়াই সময় বৃদ্ধির জন্য আইএমইডিতে অনুমোদনের জন্য আসে। একজন প্রকল্প পরিচালক থেকে ন্যূনতম ৫ লাখ করে হলেও প্রায় ১৫ কোটি টাকা কামিয়ে নেয় এ সিন্ডিকেট। সম্প্রতি আইএমইডির সাবেক এক সচিব অবসরকালে ফয়সালসহ সিন্ডিকেটের প্রধান সদস্যদের অভ্যন্তরীণ বদলি করেন। সেই যাত্রায় তদবির করে বদলি ঠেকাতে সক্ষম হন তিনি। তবে দেশের পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে বর্তমানে ক্ষোভে ফুঁসছেন আইএমইডির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত মঙ্গলবার একজন উপসচিব বলেন, কর্মকর্তারা এতটাই বিরক্ত, যে কোনো সময় তাঁকে গণধোলাই দেওয়া হতে পারে।
আইএমইডি সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ফয়সাল কবীরের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার নামে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি ভালো অবস্থানে আছি, এ জন্য লোকজন আমার পেছনে লেগেছে। ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড থাকা গাড়ি ব্যবহার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে সামনাসামনি কথা বলতে চান তিনি।
আইএমইডি বিভাগের সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন সমকালকে বলেন, কত লোক কতজনের বিরুদ্ধে কত কথাই বলে দেয়। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং সে অনুযায়ী কাগজপত্র থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×