ঢাকা শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

করোনার সুরক্ষা সামগ্রী

দাম লাগামহীন, মানেরও নেই ঠিক-ঠিকানা

দাম লাগামহীন, মানেরও নেই ঠিক-ঠিকানা

ফাইল ছবি

সাহাদাত হোসেন পরশ

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ জুন ২০২০ | ১৫:৪৯

করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় মাস্ক, অক্সি মিটার, পোর্টেবল ভেন্টিলেটর, ফেস-শিল্ড, স্যানিটাইজার, পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভসসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর দাম এখন লাগামহীন। এর মধ্যে বহু সুরক্ষা সামগ্রীর মানও খারাপ। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, কেউ কেউ আবার হাসপাতালে ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া গ্লাভস, মাস্কসহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে তা রিসাইকেল করে পুনরায় বিক্রি করছে। সংশ্নিষ্টদের পরামর্শ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর দাম ও মান নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন আইনি নজরদারি দরকার। নতুবা পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। করোনার এই দুর্যোগেও অসাধুরা মানুষের বাঁচা-মরা দেখবে না, হাতিয়ে নেবে লাখ লাখ টাকা।

বর্তমানে ফার্মেসি বা অন্যান্য স্টোরে একেকটি সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকায়। এ হিসাবে ৫০ প্যাকের এক বক্সের দাম পড়ছে ১০০০-১২৫০ টাকা। আগে ৫০ পিসের সার্জিক্যাল মাস্কের পুরো প্যাকের পাইকারি মূল্য ছিল ৬০-১০০ টাকা। খুচরা বাজারে তা প্রতি পিস বিক্রি হতো ২-৪ টাকায়।

একবার ব্যবহারযোগ্য সার্জিক্যাল মাস্ক আগে চীন থেকে আনা হতো। এখন অনেক কোম্পানি দেশে এই মাস্ক তৈরি করছে।

এ খাতের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, যে কাপড় দিয়ে একবার ব্যবহারযোগ্য সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরি হয়, বিশ্ববাজারে তার দাম কিছুটা বেড়েছে। মাস্ক তৈরির সময় অ্যাম্বুস আর দু'পাশে ফিতা লাগাতে হয়। সব মিলিয়ে পাইকারি বাজারে একেকটি সার্জিক্যাল মাস্ক ১০ টাকায় পাইকারি বিক্রি করা সম্ভব। খুচরায় তা ১২-১৩ টাকা বিক্রি করা যায়। তবে মধ্যস্বত্বভোগীরা দাম রাখছে দ্বিগুণ। কোনো ক্ষেত্রে তিনগুণ রাখা হচ্ছে। এমনকি কোনো প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ৫০ পিসের মাস্কের প্যাকেট ২০০০-২৫০০ টাকা রাখছে। ৫০ পিসের মাস্কের দাম ২২০০ টাকা রাখায় 'দারাজকে' জরিমানা করেছেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম জানান, সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করেই তাদের ব্যাংকে যেতে হয়। তবে সার্জিক্যাল মাস্ক, গ্লাভস অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া। যারা মানুষের অসহায় সময়কে পুঁজি করে পকেট কাটছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

জানা গেছে, এন-৯৫ মাস্ক দীর্ঘদিন ধরে আমদানি করে আসছিল বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠান। একটি গ্লোবেক্স করপোরেশন, অপরটি অনইন টেকনোলজি। গ্লোবেক্সের হেড অব সেলস এসএম হায়দার আলী সমকালকে বলেন, ৩০ বছর ধরে তারা এন-৯৫ আমদানি করছেন। আমেরিকান কোম্পানি 'থ্রি এম' এই মাস্ক তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও চীন ও সিঙ্গাপুরে এন-৯৫ মাস্ক তৈরির প্লান্ট রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এন-৯৫ মাস্ক আমদানি বন্ধ রয়েছে। আমাদের আঞ্চলিক অফিস থাইল্যান্ডে। এন-৯৫ মাস্কের অর্ডার থাইল্যান্ডের মাধ্যমে দিতে হয়। তবে থাইল্যান্ড তাদের দেশের মাধ্যমে এন-৯৫ মাস্ক রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে।

হায়দার আলী আরও জানান, আগে খুচরা বাজারে একেকটি এন-৯৫ মাস্ক বিক্রি হতো ১০০ টাকা। পাইকারিতে প্রতি পিস ৮০-৮৫ টাকা। এখন দেখি অনেকেই এন-৯৫ মাস্ক আনার কথা বলছেন। তারা কীভাবে নিয়ে আসছেন জানি না। সেটা কতটা মানসম্পন্ন, তাও জানি না। দামও কয়েকগুণ বেশি।

দীর্ঘদিন মেডিকেল সামগ্রী বিদেশ থেকে এনে ব্যবসা করে আসছে মাইক্রোমেড বিডি ডট কম নামে একটি কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার জাহিদ মিলন জানান, করোনা সংকট শুরুর পর বৈধভাবে যারা মেডিকেল সামগ্রী আনত তাদের অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে বসে আছেন। এখন বৈধ কোনো লাইসেন্স ছাড়াই অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী করোনা সুরক্ষা সামগ্রী চীন থেকে নানা উপায়ে এনে লাগামহীন দামে বিক্রি করছেন। করোনার সংকট চলে গেলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা মার্কেট থেকে চলে যাবেন। তখন বৈধ ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়বেন। কারণ এরই মধ্যে তারা মার্কেটের যে সুনাম নষ্ট করে ফেলেছেন।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা ভালো মানের একেকটি অক্সি মিটার বিক্রি হতো ১৪০০-১৫০০ টাকা। এখন চীনের তৈরি নিম্নমানের অক্সি মিটার বিক্রি হচ্ছে ২৫০০-৩০০০ হাজার টাকা। আবার মান নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় এসব অক্সি মিটার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

এ ছাড়া যার কাছ থেকে যেভাবে পারছে সেভাবে দাম রাখা হচ্ছে সার্জিক্যাল গ্লাভসের। ১০০ পিসের এক প্যাকেট গ্লাভসের দাম ছিল আগে ২৫০-৩০০ টাকা। এখন তা ১০০০-১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম সমকালকে জানান, করোনার সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে নানামুখী অনৈতিক বাণিজ্য হচ্ছে। কেউ যেনতেনভাবে তৈরি করছে ভেজাল ও মানহীন পণ্য। আবার কেউ দেশের বাইরে থেকে এনে কয়েকগুণ দাম রাখছে। পিপিই তৈরির আগে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে মান সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য সরকার বলেছিল। অনেক কোম্পানি ওই প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ না নিয়েই মানহীন পিপিই তৈরি করে যাচ্ছে।

জানা গেছে, মাস্কসহ কিছু সামগ্রী চীন রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই বৈধভাবে এলসি খুলে তা ব্যবসায়ীরা আনতে পারেননি। তখন বহু ব্যবসায়ী চীনের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান যোগাযোগ করে তাদের স্থানীয় মার্কেট থেকে পণ্য ক্রয় করে অবৈধভাবে নিয়ে আসেন। তাই এসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করা মুশকিল হয়।

মিটফোর্ডের করোনা সামগ্রীর ব্যবসায়ী মো. বাবু জানান, ১০০ পিস হ্যান্ড গ্লাভস বিক্রি করছেন ৯০০-১৫০০ টাকায়। চশমা প্রতি পিস ২০০-৭০০ টাকা। পিপিই বিক্রি করছেন ৩০০-১২০০ টাকা। মিটফোর্ডে স্থানীয়ভাবে তৈরি স্যাভলন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম তার কাছে রয়েছে।

পুলিশ-র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের একাধিক ম্যাজিস্ট্রেট জানান, করোনার সুরক্ষা সামগ্রীর পাশাপাশি কিছু ওষুধের দাম কয়েকটি চক্র বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালে যেসব ওষুধ চিকিৎসকরা সেবনের পরামর্শ দিচ্ছেন, সেগুলোর দাম কয়েকগুণ বাড়ানো হয়েছে। তাদের অভিমত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ন্যাশনাল টেকনিক্যাল কমিটির অনুমোদন ছাড়া করোনার সময়ে কোনো ওষুধের নামই মিডিয়ায় চিকিৎসকদের বলা উচিত নয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনহীন এ ধরনের ওষুধের নাম প্রকাশ করলে রাতারাতি তার চাহিদা বেড়ে যায়। অসাধু ওষুধ কোম্পানি সুযোগ নেয়। আবার চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়া তা খাওয়া শুরু করে সাধারণ মানুষ। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে।

র‌্যাব সূত্র জানায়, ব্যবহূত মাস্ক, পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভস বিভিন্ন হাসপাতাল ও অন্যান্য স্থান থেকে সংগ্রহ করে পুনরায় বাজারজাত করছে একটি চক্র। এরই মধ্যে এমন একটি গ্রুপের খোঁজ মিলেছে। যারা অ্যাপোলোসহ কয়েকটি হাসপাতালের বর্জ্য থেকে ব্যবহূত এ ধরনের সামগ্রী সংগ্রহ করে আবার বিক্রি করত। ভাসানটেক থানার ফাসেরটেক বালুর মাঠ এলাকায় অভিযান চালিয়ে হাসপাতালে ব্যবহূত ৪৩ বস্তা মাস্ক, পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভস জব্দ করা হয়। এই চক্রের মূল হোতা মনির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে দুই বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে।

মনির র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার অর্থায়নে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকার সব মেডিকেল বর্জ্য ডেমরার স্যানিটারি ল্যান্ডফিলে ডাম্পিং করার কথা। তবে প্রতিষ্ঠানটির কিছু অসাধু কর্মকর্তা হাসপাতালের অসাধু কর্মচারীদের সহযোগিতায় এসব মেডিকেল বর্জ্য বাইরে নিয়ে এসে বিক্রি করে।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মশিউর রহমান বলেন, কালারফুল নানা এজেন্ট ব্যবহার করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে যত্রতত্র বিক্রি করা হচ্ছে। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মিটফোর্ড হাসপাতালের গেটে বসেই নকল মানহীন স্যানিটাইজারসহ নানা ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুন

×