এএসপিদের কুচকাওয়াজ স্থগিত নিয়ে নানা প্রশ্ন
এমন ঘটনা এটাই প্রথম। সবাই আওয়ামী লীগ না– বললেন পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ
ফাইল ছবি
সাব্বির নেওয়াজ, ঢাকা ও সৌরভ হাবিব, রাজশাহী
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:৩৯ | আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৪ | ১০:৪৯
কয়েক দিন ধরে রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ছিল সাজ সাজ রব। ৪০তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষানবিশ সহকারী পুলিশ সুপারদের (এএসপি) প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ হওয়ার কথা ছিল গতকাল রোববার। প্রায় চার হাজার অতিথির জন্য আয়োজন। একাডেমি সেজেছিল বর্ণিলভাবে। প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে শনিবার রাতেই সারদায় পৌঁছান। সঙ্গে ছিলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক। কিন্তু হঠাৎ করেই স্থগিত হয়ে যায় সেই কুচকাওয়াজ।
শনিবার রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সালাউদ্দীন আম্মার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। পুলিশ একাডেমির আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে এ পোস্টে তিনি লিখেন, ‘কোনো রকম তদন্ত ছাড়াই আওয়ামী লীগের দোসরদের এএসপি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমাদের ভাইদের মৃত্যুর মিছিল এখনও চলছে। এ অবস্থায় এই দোসরদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া মানে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা।’ ফেসবুকে তাঁর এমন স্ট্যাটাসের পর স্থগিত হয়ে যায় কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, অনিবার্য কারণে সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল (অতিরিক্ত আইজিপি) মো. মাসুদুর রহমান ভূঞা বলেন, ‘উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়েছে। এটা আগামীতে হবে। এদের সবাই আওয়ামী লীগের না। কী কারণে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা আমি ওয়াকিবহাল না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যতক্ষণ প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ না হয়, ততক্ষণ প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে। এদের প্রশিক্ষণ চলবে।’
এই এএসপিরা সবাই ৪০তম বিসিএসে (পুলিশ) নিয়োগ পাওয়া। গতকাল সকাল ১০টায় একাডেমির প্যারেড গ্রাউন্ডে তাদের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ হওয়ার কথা ছিল।
কী কারণে স্থগিত
সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, ‘অনিবার্য কারণে’ কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়েছে। রাজশাহীতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও একই কথা জানান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত সালাউদ্দিন আম্মারের ফেসবুক পোস্টের কারণেই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে অনুষ্ঠানটি স্থগিতের সিদ্ধান্ত এসেছে। খোদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও আগে এ সিদ্ধান্তের কথা জানতেন না। জানলে তিনি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যেতেন না।
পুলিশ একাডেমিতে এএসপিদের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণসহ কয়েকটি সফরসূচি নিয়ে শনিবার রাজশাহীতে যান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি পুলিশ একাডেমিতেই রাত্রিযাপন করেন। কুচকাওয়াজ উপলক্ষে সারদায় পৌঁছান পুলিশ প্রধান ময়নুল ইসলাম।
কুচকাওয়াজ কেন স্থগিত, সে প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। গতকাল দুপুরে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) সদরদপ্তরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি। এ সময় বাজারদর ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। কুচকাওয়াজ স্থগিতের বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘অনিবার্য কারণে স্থগিত করা হয়েছে। ওটা ক্লিয়ার করা হইছে! ভালো থাকেন।’ এ সময় আইজিপি ময়নুল ইসলামের কাছে একই প্রশ্ন রাখেন সাংবাদিকরা। তিনিও বিষয়টি এড়িয়ে যান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র জনসংযোগ কর্মকর্তা ফয়সল হাসান সমকালকে বলেন, ‘কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনো আমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয়নি। আমন্ত্রণপত্র বিতরণ হয়েছে স্থানীয়ভাবে। তাই কুচকাওয়াজ না হওয়ার বিষয়টি রাতে স্থানীয়ভাবে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ একই তথ্য জানিয়ে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘অনিবার্য কারণবশত অনুষ্ঠানটি স্থগিত করা হয়েছে।’
এমন ঘটনা এবারই প্রথম
সব আয়োজন সম্পন্ন করে এভাবে কুচকাওয়াজ স্থগিত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। সাবেক একাধিক আইজিপি সমকালকে বলেন, প্রশিক্ষণার্থী সহকারী পুলিশ সুপারদের পুরো ব্যাচের কুচকাওয়াজ স্থগিতের ঘটনাটি নজিরবিহীন। সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, ‘এটি আইনবহির্ভূত না হলেও একটু অস্বাভাবিক এবং কিছুটা নজিরবিহীন।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অতীতে কয়েকটি ব্যাচের লম্বা সময় প্রশিক্ষণে রাখার ঘটনা ঘটেছে। অথবা প্রশিক্ষণ চলাকালে বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে অনেকে বাদ পড়েছেন। কিন্তু পুরো ব্যাচের কুচকাওয়াজ স্থগিতের ঘটনা আগে ঘটেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশিক্ষণকালে কারও আচরণ যথাযথ না হলে তাঁকে সরাসরি বাদ দেওয়ার এখতিয়ার কর্তৃপক্ষের আছে। এ ছাড়া আবেদনের সময় যেসব তথ্য প্রার্থী দেন, সেগুলোর কোনোটি অসত্য প্রমাণিত হলেও ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তাই বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ শেষে কুচকাওয়াজে যোগ দেওয়ার অনুমতি না পাওয়ার নজির পুলিশ বাহিনীতে আছে।
দুশ্চিন্তায় ৬৬ শিক্ষানবিশ এএসপি
কুচকাওয়াজ স্থগিতের ঘটনায় এক বছর প্রশিক্ষণ নেওয়া ৬৬ এএসপি হতাশায় পড়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের কয়েকজন জানান, দু-চারজন রাজনীতিতে যুক্ত থাকতে পারেন, কিন্তু অধিকাংশই ছিলেন রাজনীতির বাইরে। কেউ কেউ ভালো চাকরি ছেড়ে এ চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বিসিএসে অন্য ক্যাডারের চাকরি ছেড়ে এসেছেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা সবাই চিন্তায় পড়েছেন।
সাধারণত বিসিএসে নিয়োগ পাওয়ার পর পুলিশ কর্মকর্তারা সারদার পুলিশ একাডেমিতে এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণ নেন। সমাপনী কুচকাওয়াজের মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়। এর পর তারা মাঠপর্যায়ে কাজের সুযোগ পান।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৪০তম বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। অভিযোগ উঠেছে, ওই ব্যাচে অন্তত ৬২ জন ছাত্রলীগ নেতা নিয়োগ পেয়েছেন। সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ৪০তম বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এর পর প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাসহ যাচাই বাছাইয়ের ধাপ শেষে ২০২২ সালের নভেম্বরে নির্বাচিতদের গেজেট প্রকাশ করে সরকার।
গেজেট অনুযায়ী তখন ৭১ জন সহকারী পুলিশ সুপার পদে যোগদানের কথা। যাদের মধ্যে ৬২ জন দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষে গতকাল একাডেমিতে সমাপনী কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মারকেও।
কুচকাওয়াজ স্থগিতের পরে ফেসবুকে আরেক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করেছে পুলিশ একাডেমি সারদা। কিছুদিন ধরে চলা অনুষ্ঠান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা গতকাল থেকেই রাজশাহীতে থাকার পরও মাত্র জানাল ক্যান্সেল করা হয়েছে। কিছু বুঝলেন? আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের আমরা কখনো গ্রহণ করব না। তদন্ত হোক পরে যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ পাক।’
এ বিষয়ে সালাউদ্দীন আম্মার সমকালকে বলেন, ‘আমার ফেসবুক পোস্টের পর বিভিন্ন জায়গায় কথা হয়েছে। আমাদের ৫ জন সমন্বয়ক এটা প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা সেন্ট্রালকে জানাই। তারপর আমাদের সেন্ট্রাল থেকে জানানো হয়, এটা স্থগিত করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চেয়েছি তদন্ত হোক। তদন্তের মাধ্যমে যারা দলীয় ব্যানারে আছে, তাদের নিয়োগ বাতিল করতে হবে এবং শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আর আমরা সবাই জানি যে আবেদ আলীর প্রশ্নফাঁসের একটি ইস্যু আছে। তাই আমরা তদন্ত চেয়েছি। মেধার মাধ্যমে যারা আসছে, আমরা সাদরে তাদের গ্রহণ করব।’
কী ভাবছে সরকার
জননিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, সরকারের দুটি গোয়েন্দা সংস্থা আবার পৃথকভাবে ৪০ বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া এএসপিদের প্রাক-পরিচিতি যাচাই করবে। এর পর আবার কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হবে। গোয়েন্দা তথ্যে যাদের বিষয়ে নেতিবাচক কিছু পাওয়া যাবে না, তারা কুচকাওয়াজে অংশ নিতে পারবেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সূত্র জানায়, তারাও মনে করে না, নিয়োগ পাওয়া ৬৬ জনের মধ্যে ৬২ জনই ছাত্রলীগ নেতা। তবু সতর্কতার সঙ্গে সবার সব তথ্য যথাযথভাবে যাচাই করে দেখা হবে।
- বিষয় :
- এএসপি