ঢাকা সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

বালাশী-বাহাদুরাবাদ নৌপথ

১৭৫ কোটি টাকা ব্যয়, ফেরি চলল না এক দিনও

নাব্য সংকটে চালুর আগেই ফেরি বন্ধ ঘোষণা, কিছুদিন চলেছিল লঞ্চ

১৭৫ কোটি টাকা ব্যয়, ফেরি চলল না এক দিনও

আড়ম্বরে উদ্বোধন হলেও কখনও ফেরিঘাটের গেট খোলেনি। গাইবান্ধার ফুলছড়ির বালাশী ফেরিঘাট টার্মিনাল -সমকাল

 আনোয়ার হোসেন মিন্টু, জামালপুর, মাসুম লুমেন, গাইবান্ধা

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:৫১ | আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৪ | ১১:০৯

যমুনা নদীতে গাইবান্ধার বালাশী ঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার নৌরুট এবং দুই প্রান্তে টার্মিনাল তৈরির কাজ শেষ হয় ২০২১ সালের জুনে। পৌনে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প শেষে ফেরি চলাচলের কথা থাকলেও নাব্য সংকটে এক দিনও তা চলেনি। এর পর কিছুদিন লঞ্চ চললেও বন্ধ হয়ে যায়। অভিযোগ উঠেছে, যমুনার ওই স্থানে এত বড় নৌপথ চালু রাখা প্রায় অসম্ভব। এটি জানা সত্ত্বেও জনগণের টাকা লুটপাট করতে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। 

স্থানীয়রা জানান, যমুনার দুই পাড়ে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে ময়মনসিংহ এবং রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে এখানে একটি নৌরুট প্রয়োজন। ব্রিটিশ আমল থেকে গাইবান্ধার তিস্তামুখ-বাহাদুরাবাদ নৌপথ চালু ছিল। উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানীতে যাতায়াতে দু’পাশে ছিল রেললাইনও। চলাচল করত ফেরি। ১৯৯০ সালে নাব্য সংকটে তিস্তামুখঘাটটি স্থানান্তর হয় বালাশীতে। এর পর যমুনা বহুমুখী সেতু চালুর পর ২০০০ সাল থেকে ফেরি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এতে স্থানীয়দের যাতায়াতের পাশাপাশি সংকট বাড়ে পণ্য আনা-নেওয়ায়। কারণ, সড়কপথে যমুনা সেতু হয়ে এই দুই ঘাটের দূরত্ব ২৮৭ কিলোমিটার। 

বিআইডব্লিউটিএর তথ্যমতে, উত্তরের ১৩ জেলার মধ্যে পণ্য সরবরাহ সহজ করতে এবং যমুনা সেতুতে যানবাহনের চাপ কমাতে ২০১৪ সালের দিকে এই নৌপথে ফের ফেরি চালুর সিদ্ধান্ত নেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ২০১৪ সালের মার্চে তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া নৌপথটি পরিদর্শন করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর একনেকে পাস হয় ‘বালাশী ও বাহাদুরাবাদে ফেরিঘাটসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ’ প্রকল্প। এতে ড্রেজিং করে নৌপথ সচল এবং দুই প্রান্তে ফেরি টার্মিনাল ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। পরে কয়েক দফায় তা বাড়ালে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। 

তবে চরম ভুল করা হয় নৌপথ নির্ধারণে। বালাশী থেকে বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত প্রায় ২৬ কিলোমিটারের যে নৌপথ নির্ধারণ করা হয়, যমুনা নদীর এ অংশে কিছুদূর পরপরই আছে চর-ডুবোচর। এত বড় রুট নিয়মিত ড্রেজিং করেও নৌচলাচলের উপযোগী রাখা প্রায় অসম্ভব। অথচ বালাশীঘাট থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলারই সানন্দবাড়ী পর্যন্ত নৌপথের দূরত্ব ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার। এখানে যমুনা বেশ প্রশস্তও। সানন্দবাড়ী থেকে ময়মনসিংহ ও ঢাকায় সড়ক যোগাযোগও রয়েছে। তবে এই পথ বাদ দিয়ে ২৬ কিলোমিটার নৌরুট চালুর সিদ্ধান্ত হয় মূলত লুটপাট করতেই।  

বিআইডব্লিউটিএর এক প্রকল্প পরিচালকের কথায়ও এর প্রমাণ মেলে। নাম প্রকাশ না করা শর্তে তিনি সমকালকে  বলেন, আসলে প্রকল্পের লক্ষ্য ভালো ছিল। তবে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির উদ্দেশ্য ভালো ছিল না। ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে নাব্য সংকট দেখা দেবে জানার পরও প্রকল্পটি নেওয়া হয়। অথচ বালাশীঘাট থেকে সানন্দবাড়ী পর্যন্ত নৌপথটি করলে দূরত্ব হতো ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার। নদীর গতিপ্রকৃতি, ঠিকমতো সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া ব্যয় বাড়াতে বড় রুট নির্ধারণের কারণে এত কোটি টাকার প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। লুটপাটের ধান্দা না করে নৌপথটি সানন্দবাড়ী পর্যন্ত করলে নাব্য সংকটও দেখা দিত না।

সংশ্লিষ্টদের সেই ‘অসৎ উদ্দেশ্যে’র প্রমাণ পাওয়া যায় প্রকল্প শেষের আগ দিয়েই। ২০২১ সালে দুই নৌঘাটের ভৌত কাঠামো নির্মাণ প্রায় শেষে আকস্মিকভাবে বিআইডব্লিউটিএর কারিগরি কমিটি নাব্য সংকট ও ২৬ কিলোমিটার দূরত্বের সমস্যার কথা তুলে ধরে নৌপথটি ফেরি চলাচলের অনুপযোগী ঘোষণা করে। ওই বছরের এপ্রিলে সমস্যা খুঁজে দেখতে কমিটি করে সংস্থাটি। ভৌত কাজের গুণগতমান ও তদারকির অভাব, নাব্য সংকট, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতাসহ নানা দিক তুলে ধরে পথটি ফেরি চলাচলের অনুপযোগী বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সেই কমিটি। নদীর মরফোলজিক্যাল (রূপতত্ত্ব বা ভৌগোলিক অবস্থা ও গতি-প্রকৃতি) অবস্থা না জেনে ফেরিঘাট নির্মাণ করায় তা স্থানান্তর এবং অবকাঠামোগুলো অন্য কাজে ব্যবহারের সুপারিশ করে কমিটি।

এর পর ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল নৌপথটি উদ্বোধন করতে যান তৎকালীন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। উদ্বোধনের দিনই নাব্য সংকট নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর প্রকৌশলীদের ওপর ক্ষোভও দেখান প্রতিমন্ত্রী। পরে প্রতিমন্ত্রীকে দিয়ে ফেরির বদলে লঞ্চ সার্ভিস উদ্বোধন করানো হয়। প্রথমে দুটি এবং পরে ছয়টি লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা করা হলেও নাব্য সংকটে তাও কিছুদিন পর চলেনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, ড্রেজিংয়ের সময় বালু দূরে না ফেলে নদীতেই ফেলা হয়। এ ছাড়া লোক দেখানো নামমাত্র ড্রেজিং করে অর্থ লুটপাট করায় নৌপথটিতে লঞ্চও চালানো যায়নি।

সরেজমিন উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাশীঘাট এবং দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ফেরি টার্মিনালে দেখা যায়, আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন নৌটার্মিনালজুড়ে সুনসান নীরবতা। পড়ে রয়েছে যাত্রীদের জন্য আধুনিক বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস, আধুনিক ডিজাইনের মসজিদ, রেস্তোরাঁ, আনসার ব্যারাকসহ সব স্থাপনা।

বাহাদুরাবাদঘাট যেতে বালাশী টার্মিনাল এলাকায় নৌকার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকায় চাকরি করি। জামালপুরে শ্বশুরবাড়ি হয়ে ঢাকা যাব। আগে ফেরিতে নিরাপদে পারাপার হতাম। এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় নদী পার হতে হয়।’

স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ফেরি চালু হলে অল্প সময়ে ও কম খরচে আমরা ঢাকায় মালপত্র আনানেওয়া করতে পারতাম। এই এলাকায় শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারও হতো। অথচ সরকারের এতগুলো টাকা খরচ হলেও আমাদের কোনো লাভই হয়নি। 

বালাশী-বাহাদুরাবাদ ফেরি সার্ভিস চালু দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করা গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, উত্তরবঙ্গের ১৩ জেলার মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন হবে– এ জন্যই দাবি তুলেছিলাম। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে আলিশান ফেরি টার্মিনাল হলো। নাব্য সংকট দূর করতে ড্রেজিংয়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলো। এসবই ছিল লোক দেখানো। আসলে এ প্রকল্প নেওয়াই হয়েছিল লুটপাটের জন্য।

উদ্বোধনের পর থেকেই তালাবদ্ধ জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট টার্মিনালের কার্যালয়	-সমকাল

দেওয়ানগঞ্জের চুকাইবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদুজ্জামান সেলিম খান অভিযোগ করেন, বিআইডব্লিউটিএর দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী ও তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়া শুধু নিজেদের স্বার্থে অপরিকল্পিতভাবে মেগা প্রকল্পটি হাতে নেয়। নদী খনন এবং নৌটার্মিনাল নির্মাণ বরাদ্দ থেকে তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। লুটপাটের পরিমাণ এতই বেশি ছিল, নৌপথ উদ্বোধনের আগেই ফেরি চলাচলের অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়।
এ নৌরুটে যাতায়াতকারী দিনাজপুরের নূর আলম খান বলেন, এই প্রকল্প আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্নীতির একটি উদাহরণ। সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে, অথচ একটি দিনও সুবিধা পাওয়া যায়নি।

গাইবান্ধার বোনারপাড়া থেকে আসা নৌকার যাত্রী আমীর হোসেন বলেন, যমুনা সেতু চালুর পর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে বাস ও ট্রেনে সরাসরি ঢাকায় যাতায়াত করা গেলেও অনেক সময় লাগে। দুর্ভোগও পোহাতে হয়। বালাশী-বাহাদুরাবাদ নৌপথে ফেরি চললে যমুনার দুই পাড়ের লাখ লাখ মানুষের যাতায়াত সহজ হতো। কৃষকরা সহজেই ফসল নদীর ওপারের জেলাগুলোতে বাজারজাত করতে পারতেন। এতে এ অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হতো।

জামালপুর জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, এই নৌপথ চালু হলে বৃহত্তর ময়মনসিংহের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের কয়েক জেলার যোগাযোগে খরচ ও সময় অনেক কম লাগত। যমুনা সেতুর ওপর চাপও কমত। অথচ প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে লুটপাট হয়েছে। এতে জড়িত সবার বিচার হওয়া দরকার।

বিআইডব্লিউটিএর এক কর্মকর্তা বলেন, ২৬ কিলোমিটারের এ নৌরুট বর্ষা মৌসুমেই পার হতে ৪-৫ ঘণ্টা সময় লাগে। শুষ্ক মৌসুমে পলিতে নৌযান আটকে যায়। এ জন্য লঞ্চ মালিকরা এ রুট ব্যবহারে আগ্রহী নন। স্টেকহোল্ডার অ্যানালাইসিস ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করে প্রকল্পটির স্থান নির্ধারণ করায় পুরো টাকাটাই গচ্চা গেছে।
প্রকল্পটির স্থাপনা ও নদী খননের (ড্রেজিং) কাজ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসএস রহমান ইন্টারন্যাশনাল। ঢাকা থেকে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী রকিবুল ইসলাম দিপুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প ম্যানেজার (পিএম) বায়েজিদ হোসেন সমকালকে বলেন, দুই পাড়ে স্থাপনা নির্মাণের কাজগুলো আমি সরাসরি তদারকি করলেও ড্রেজিংয়ে যুক্ত ছিলেন বিআইডব্লিউটিএর ইঞ্জিনিয়াররা। আমাদের প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিনিধি শুধু সমন্বয় করেছেন। লোক দেখানো ড্রেজিংয়ের কারণে প্রকল্পটি কাজে আসেনি বলে অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের ইঞ্জিনিয়াররা বলতে পারবেন।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর প্রকৌশল বিভাগের প্রধান (ড্রেজিং) রাকিবুল ইসলাম তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বিআইডব্লিউটিএর প্রকল্পটির পরিচালক নিজাম উদ্দীন পাঠান বলেন, দীর্ঘ পথ এবং নাব্য সংকটের কারণে ফেরি সার্ভিস চালু করা যায়নি। এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন জানিয়ে তিনি ফোনের সংযোগটি কেটে দেন।

বিআইডব্লিউটিএর অন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে সরাসরি এবং মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।


 

আরও পড়ুন

×