সমকাল ও ওয়াটারএইড গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
অবহেলিত স্যানিটেশন কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ে মঙ্গলবার ‘স্যানিটেশন কর্মীদের জীবনমান উন্নয়ন এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিলে বক্তারা। ছবি- সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪ | ১০:৩৯ | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৪ | ১০:৪৪
পৌরসভা থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন– সবখানেই বৈষম্যের শিকার স্যানিটেশন কর্মীরা। প্রাপ্য মজুরি তারা পান না। সবার চাকরিও স্থায়ী নয়। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করলেও নেই ঝুঁকি ভাতা। নারী স্যানিটেশন কর্মীরা পান না মাতৃত্বকালীন ছুটি। সপ্তাহে সাত দিনই কাজ করতে হয়। অথচ সমাজে তারা অবহেলিত। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় এই স্যানিটেশন কর্মীদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে; তাদের সুরক্ষা দিতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল সভাকক্ষে এক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন বক্তারা।
‘স্যানিটেশন কর্মীদের জীবনমান উন্নয়ন এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে করণীয়’ শীর্ষক ওই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে ‘সমকাল’ ও ‘ওয়াটারএইড বাংলাদেশ’। সার্বিক সহায়তায় ছিল বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
এতে বক্তব্য দেন ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান, এসএনভি নেদারল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের সেক্টর লিড শহিদুল ইসলাম, প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশের টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট তাহমিদ হোসেন, ওয়াটারএইড বাংলাদেশের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট ইয়াসিন আরাফাত, বাংলাদেশ হরিজন যুব ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পংকজ বাসফোর, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী নির্মলা ও নাগমণি লতা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী আবদুস সালাম ও হালিমা বেগম, টাঙ্গাইলের সখিপুর পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মী পারুল আক্তার এবং নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মী টার্জেন বাসফোর। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সমকালের বার্তা সম্পাদক (অনলাইন) গৌতম মণ্ডল।
হাসিন জাহান বলেন, ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করেন, তাদের একটি নীতিমালায় আনা প্রয়োজন; যার মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতন বৈষম্য দূর হবে। নীতিমালায় ন্যূনতম মজুরি প্রদান, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও ক্ষতিকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো বিষয় থাকতে হবে।’ নারী স্যানিটেশন কর্মীদের জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টি ভাবা জরুরি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্যানিটেশন কর্মীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অনেক উদ্যোগ রয়েছে; কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন হয় কিনা, তা দেখভাল করা হচ্ছে না। তাই সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘স্যানিটেশন কর্মীদের কাজের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভবন মালিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে।’
সঞ্চয়ের মনোভাব তৈরির আহ্বান জানিয়ে তাহমিদ হোসেন বলেন, ‘আর্থিক বৈষম্যের শিকার স্যানিটেশন কর্মীদের সঞ্চয় করতে হবে। অল্প অল্প করে সঞ্চয় করেই বড় কাজ হতে পারে। এ জন্য সমিতি গড়ে তুলতে হবে।’
দেশের সব পৌরসভায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীর জন্য একই বেতন কাঠামো দাবি করেন পংকজ বাসফোর। তিনি বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা পরিবার নিয়ে ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন। তাদের আবাসন সমস্যা দূর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া বছরের পর বছর কাজ করেও অনেকে চাকরিতে স্থায়ী হতে পারেন না। তাদের সামাজিক কোনো মর্যাদাও নেই।’ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার জন্য পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ঝুঁকি ভাতা দাবি করেন তিনি।
নির্মলা বলেন, ‘আমরা অনেক সময় প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কাজ করি। কিন্তু কাজের মাঝে কোথাও বসে বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা নেই। অনেক সময় বয়স্ক ব্যক্তি এ কাজ করেন। বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা না থাকায় তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন।’ বিশেষ করে সিটি করপোরেশন এলাকায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য তিনি ছাউনি তৈরি ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করার দাবি জানান।
নাগমণি লতা বলেন, ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষার ন্যূনতম সুবিধা নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা পান না। পিরিয়ডের সময় তাদের বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। তারা নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন।’ অনেক সময় গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে বাসায় ফেরার সময় নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কটূক্তির শিকার হন বলে উল্লেখ করেন তিনি। নাগমণি বলেন, ‘এত কিছুর পরও আমাদের না আছে ভালো মজুরি, না আছে ভালো থাকার জায়গা।’
পরিচ্ছন্নতাকর্মী আবদুস সালাম বলেন, ‘আমাদের নিয়োগ স্থায়ী নয়, একটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে আমরা অস্থায়ী চাকরি করি। বেতনও সামান্য। ময়লা টানার একটি গাড়ি আছে। সেটিও নিজের টাকায় বানানো। সেই গাড়ি ঠেলতে আরেকজন লাগে। যে মজুরি পাই, তার অর্ধেক দিতে হয় তাঁকে।’
হালিমা বেগম বলেন, ‘ময়লা নিতে গিয়ে কাচের টুকরায় হাত কেটে যায়। ময়লার ঝুড়িতে কেন কাচ– জানতে চাইলে বাড়িমালিকের অপমানজনক কথা শুনতে হয়।’ অনেক ধৈর্য নিয়ে এ পেশায় থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পারুল আক্তার বলেন, ‘এই পেশার কারণে মানুষের কাছে সম্মান পাই না। নিজের পরিচয় গোপন রেখে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। কারণ, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সন্তান জানতে পারলে অবহেলার শিকার হতে হয়। সমাজের মানুষ মনে করে, এটি নিচু পদের কাজ। তাই সবাই দূরত্ব রেখে চলে।’
টার্জেন বাসফোর বলেন, ‘দিনে ৫০০ টাকা হাজিরার নিচে এখন মজুরি পাওয়া যায় না। অথচ অনেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী দৈনিক হাজিরা পান মাত্র ২৪০ টাকা। করোনাকালে মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে ঘর থেকে বের হয়নি। তখনও আমরা শহর পরিষ্কার করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কেউ কেউ হোটেলে ঢুকে খেতে পারেন, কিন্তু আমরা পারি না। আমাদের বসতেও দেয় না। মানুষ হিসেবে ন্যূনতম মর্যাদাটুকু আমাদের নেই।’
গৌতম মণ্ডল বলেন, ‘শুধু সামাজিক সচেতনতা তৈরি নয়, স্যানিটেশন কর্মীদেরও নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। অন্য খাতের শ্রমিকরা কেমন মজুরি পাচ্ছেন– সে বিষয়ে খোঁজ রাখতে হবে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মজুরি দাবি করতে হবে।’ স্যানিটেশন কর্মীদের ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।