জলবায়ু সম্মেলন
সম্মেলনের মাঝপথে এসেও ইঙ্গিত নেই অর্থায়নের
বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশের চিৎকার কানে যাচ্ছে না
কোলাজ
আজারবাইজান থেকে, জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৪
তামাম দুনিয়ায় ‘তেলের আঁতুড়ঘর’ হিসেবে পরিচিত আজারবাইজান। দেশটির অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলনের ওপর। তেলরাষ্ট্র হওয়ার পরও ২৯তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৯) আসর বসেছে দেশটির রাজধানী বাকুতে। এমন এক দেশে সম্মেলন বসার বিষয়ে শুরু থেকেই জলবায়ুকর্মীরা ছিলেন সমালোচনামুখর। ১৮০ দেশের অন্তত ৮০ হাজার প্রতিনিধি জলবায়ু সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ১১ নভেম্বর থেকে জড়ো হয়েছেন নয়নাভিরাম এই শহরে। আলোচনা চলবে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহ। এ ক’দিন শক্তিশালী কথামালা, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে হয়েছে আলোচনা।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত গোটা বিশ্বকেই ফেলেছে সংকটে। বিষয়টি অন্তত প্রতীকীভাবে মানানসই হতো, যদি এই শহরে জড়ো হওয়া রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতারা তাদের আত্মতুষ্টির জন্য লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকতেন! ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর চিৎকার মোড়লদের কানেই যাচ্ছে না। সম্মেলনে অংশ নেওয়ার তালিকায় বড় বিশ্বনেতা অনেকের নামই নেই। পর্যায়ক্রমে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়টি সমর্থন করে না– এমন দেশগুলোর জলবায়ু সংলাপের আয়োজক হওয়াও উচিত নয় বলে মনে করেছেন বিশ্লেষকরা। দূষণ ছড়াতে যারা ‘ওস্তাদ’ সেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ফ্রান্স বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন জলবায়ু সম্মেলনকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ফলে সম্মেলন যেমন চলার তেমন চলছে। দাবি-দাওয়া যার যা জানানোর কথা, তাও জানানো হচ্ছে। তবে আদৌ কি অর্থায়নের কোনো সুরাহা হবে? সম্মেলনের মাঝপথে এসেও এর কোনো ইঙ্গিত নেই। পরিবেশ নিয়ে যারা ভাবেন, তারা বিক্ষোভ করেই যাচ্ছেন। তবে সেই বিক্ষোভ কারও টনক নড়াতে পারেনি।
গেল এক সপ্তাহে সম্মেলনে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল তাপমাত্রা, অর্থায়ন, অভিযোজন তহবিল, অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি তহবিল ও বিশ্বব্যাংক সংস্কারের বিষয়। দূষণ রোধে পরিবেশের জন্য নিবেদিত মানুষ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে চালাচ্ছেন দরকষাকষি। প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে কত অর্থ পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা পাওয়ার কোনো ইতিবাচক লক্ষণ এখনও নেই। মনে করা হচ্ছে, ২২ নভেম্বরের পরও হয়তো আরও দু-এক দিন এই দরকষাকষি চলবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিপূরণের অর্থ পাওয়ার আশা দেখছেন না বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ থেকে জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেওয়া তরুণদের একটি দল গতকাল বাকুতে বিক্ষোভ করেছে। তারা বলছেন, এক বিলিয়ন ডলারও দিতে রাজি নয় উন্নত বিশ্ব। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় বছরে দরকার আড়াই বিলিয়ন। ক্ষতিপূরণের বদলে সবাই সবুজ শিল্পে বিনিয়োগের জন্য ঋণ দিতে চায়।
জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বহুমুখী ক্ষতির মুখে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র। জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন অর্থ বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থা। সবুজ শিল্প গড়তে এই অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তারা। তবে এই অর্থ নিতে হলে গুনতে হবে ঋণ আর কিছু শর্ত। গত ছয় দিনে অভিযোজন, প্রশমন, ক্ষয়ক্ষতি, প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে অর্থ আসবে কীভাবে, সেটি কেউ বলছেন না। ক্ষতিপূরণের বিষয়ে এবারও একমত নাও হতে পারে দেশগুলো।
দেশগুলো বলছে, তারা বেসরকারি বিনিয়োগ পেতে হিমশিম খাচ্ছে। কারণ, এ ধরনের বিনিয়োগ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে এসব দেশের গণমানুষের জন্য জাতিসংঘ তহবিলই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশগুলোর বেশির ভাগ মানুষ যুদ্ধ আর প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগে পড়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা বলছেন, এবারও কোনো প্রাপ্তি ছাড়াই শেষ হতে পারে সম্মেলন। সম্মেলনের ষষ্ঠ দিনে গতকাল মূলত জলবায়ু অর্থায়নের বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। বিশ্বে সংঘাত পীড়িত এবং জলবায়ুর পরিবর্তনে ক্ষতির মুখে থাকা একঝাঁক দেশ এবারের সম্মেলনে দ্বিগুণ আর্থিক সাহায্য দাবি করেছে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা আরও বলছেন, বরাবরের মতো ধীরগতিতে চলছে দেন-দরবার। দেশগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা এবং নিরাপত্তা সংকটের মুখে থাকা তাদের জনগণের জন্য বছরে দুই হাজার কোটিরও বেশি ডলার সাহায্য দেওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছে।
সম্মেলনে যোগ দেওয়া দেশগুলো জলবায়ু তহবিল প্রশ্নে নতুন একটি বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা নেওয়ার ব্যাপারে একমত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এর মধ্যেই নাজুক পরিস্থিতিতে থাকা দেশগুলো চরম আবহাওয়া মোকাবিলায় ভালো প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আরও তহবিল দাবি করছে। নাজুক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্র। তাদের যুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রস্তর বেড়ে যেতে থাকায় তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। অন্যদিকে, চিরহরিৎ বনাঞ্চল থাকা দেশগুলো কার্বন নির্গমন কম রাখতে তাদের এই বন রক্ষায় আরও বেশি অর্থ প্রয়োজন বলে জানিয়েছে।
কপের বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরা হলো ফেনীর ভয়াবহ বন্যার চিত্র
গত আগস্টে বাংলাদেশের ফেনীসহ এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বন্যার ভয়াবহতার দৃশ্য চিত্রায়ণ হয়েছে জলবায়ু সম্মেলনে। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে এবারের কপ২৯-এ স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নারী-পুরুষ, শিশুদের উদ্ধার কাজে বিড়ম্বনা, ঝুঁকি মাথায় নিয়ে তরুণদের কাজ করার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। এ উপলক্ষে গতকাল বাকুতে জলবায়ু সম্মেলনের ‘ওয়াটার ফর ক্লাইমেট’ প্যাভিলিয়নে আয়োজিত বিশ্ব সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এই প্যাভিলিয়নে ‘ইয়ুথ ফর ওয়াটার জাস্টিস’ শীর্ষক এ বিশ্ব সংলাপের আয়োজন করে মিশন গ্রিন বাংলাদেশ (এমজিবি), ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট (ওয়াইপিএসডি), বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (ন্যাকম) ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ।
সংলাপে বক্তারা বলেন, গত আগস্টের বন্যার সময় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ছিল নতুন, তাই সরকার বন্যাদুর্গতদের পাশে সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। এই বন্যার জন্য মোড়লরা দায়ী থাকলেও বিশ্ববাসী পাশে দাঁড়ায়নি। এ সময় বন্যাদুর্গতদের জীবন বাঁচাতে ও বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে দেশের তরুণ সমাজ। ভয়াবহ এই বন্যা মোকাবিলার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে, জলবায়ুজনিত দুর্যোগ মোকাবিলা ও পানির ন্যায্যতা নিশ্চিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করার বিকল্প নেই। তাই জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে তরুণদের ‘পেইড ভলান্টিয়ার’ হিসেবে যুক্ত করার পরামর্শও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসাইন খান বলেন, ‘পানির ন্যায্যতা হলো জলবায়ু ন্যায্যতার একটি বড় অংশ। প্রকৃতিকেন্দ্রিক বৈশ্বিক শাসনের জন্য জাতীয় এবং আন্তঃসীমান্তীয় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা জরুরি। বিশেষ করে তরুণদের জন্য এটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তরুণরাই পৃথিবীতে প্রকৃতিভিত্তিক উন্নয়নের পরিচালক।’
ক্যাপসের চেয়ারম্যান ড. আহমেদ কামারুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক পরিসরে যতই ক্ষতিপূরণ চাই না কেন, আমাদের মনঃস্তাত্ত্বিক ক্ষয়ক্ষতি, পৈতৃক ঘরবাড়ি হারানো, ধর্মীয় স্থাপনা হারানোর বেদনা কীভাবে সামাল দেব? তাই ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করার সময় মানসিক বিষয়গুলোও মাথায় রাখতে হবে। সেই সঙ্গে শুধু ক্ষতিপূরণের দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তরুণদের জলবায়ু, পানির ন্যায্যতাসহ সব পরিবেশ সমস্যায় সম্পৃক্ত করা জরুরি।’
এলডিসি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর দায়িত্ব চাপানো অন্যায্য
গতকাল জলবায়ু সম্মেলনে নাগরিক সমাজের এক আলোচনায় ২০২৫-৩০ সময়কালের জন্য জলবায়ু অর্থায়নের জন্য ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের নতুন লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করার দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোর বদলে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর দায়িত্ব চাপানোর জন্য তৈরি যে কোনো নোট ও মানদণ্ডের বিরোধিতা করা হয়।
এদিকে, ‘মিলিয়ন থেকে ট্রিলিয়ন: জলবায়ু ন্যায্যতার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জোগান’ শিরোনামে এই সংলাপটি কপ২৯ সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। সভায় এই বিষয়ে তারা তাদের মত তুলে ধরেন।
- বিষয় :
- পরিবেশ