সংবিধান
রাজনৈতিক ঐকমত্যে হতে পারে সংশোধন
সংবিধান
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ০১:৫৪
পুনর্লিখন নয়, জনআকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন পদ্ধতি, বিচার বিভাগ, স্থানীয় সরকার এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় কাঠামোগত সংস্কারকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে সেটিও হতে হবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত না হলে গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করা যাবে না।
গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘সংবিধানের খসড়া প্রস্তাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন। আইন, বিচার, সংবিধান ও মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন ল রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) এই সভার আয়োজন করে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেনের সভাপতিত্বে এলআরএফের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান জাবেদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় সংবিধানের খসড়া প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন সাংবাদিক সালেহ উদ্দিন। এতে তিনি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইন সভা, নির্বাচন পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল, নির্বাচন কমিশন এবং বিচারক নিয়োগে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন পুনর্গঠনসহ নানা বিষয়ে প্রস্তাব তুলে ধরেন।
সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। এ ছাড়া আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ব্যারিস্টার আহাসানুল করিম, অধস্তন আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মাসদার হোসেন, গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম, ব্যারিস্টার মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান খান, অ্যাডভোকেট রাজা দেবাশীষ রায়, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক সাইমী ওয়াদুদ, অ্যাডভোকেট শিশির মনির।
পরে মুক্ত আলোচনায় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বর্তমান সংবিধান এখনও বহাল রয়েছে। এই সরকার সংবিধান সংশোধন করতে পারবে কিনা সেটা ভেবে দেখতে হবে। কারণ সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথাও ভেবে দেখতে হবে। তিনি বলেন, যদি সংবিধান সংস্কার করে গণতন্ত্র এবং জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যায়, তাহলে দেশের অন্য সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আসাদুজ্জামান বলেন, এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার তা করলে সেই সংবিধান সার্বভৌম হবে, সেই সংবিধানে বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে; যেখানে রুল অব ল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, মৌলিক মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার, আরও যা যা মানুষের প্রত্যাশার জায়গা সব নিশ্চিত হবে। যদি এসব করা না হয়, তাহলে যতই প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানো হোক না কেন, কোনো প্রতিষ্ঠানই ঠিকভাবে কাজ করবে না।
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান অনুযায়ী ১১৬ অনুচ্ছেদে ফিরে যাওয়া উচিত, যাতে অধস্তন আদালত সরাসরি উচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। আর এখন সংবিধান পুনর্লিখন হবে, নাকি সংশোধন হবে, সেটা জনগণ সিদ্ধান্ত দেবে। সেটা তো সংবিধানে লেখা থাকবে না। পরবর্তীতে যেই সরকার আসবে, তারা সেটা রেটিফাই করবে। তাহলে সমস্যা থাকবে না।
আরেক সাবেক বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন বলেন, সৎ মানুষ না থাকলে আইন কোনো সুফল আনবে না। সংসদ সদস্যদের জন্য একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রস্তাব দিয়ে তিনি আরও বলেন, নারীদের রাষ্ট্র কাঠামোতে জড়ানো ঠিক নয়। তাদের সমাজ (গৃহ) সংস্কারের মধ্যেই রাখা উচিত। অনুষ্ঠানে এ নিয়ে দীর্ঘ ব্যাখ্যা দিলে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে তাঁর বক্তব্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংবিধান শুধু আইনজ্ঞদের বিষয় নয়, এটি সব জনগণের। সংবিধানকে নষ্ট করা হয়েছে, অনেকগুলো নির্বাচনকে নষ্ট করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি নষ্ট করা হয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংবিধানের মাধ্যমে। এটি ভয়ানক সংশোধনী। এগুলো পরিবর্তন করা দরকার। অনেকে মনে করেন পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে ত্রয়োদশ সংশোধনী বহালের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফেরত আসবে। এটি ঠিক নয়। এগুলো করতে হলে সংসদ লাগবে।
তিনি আরও বলেন, সংসদীয় আসন ৪০০টি হতে পারে, এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তবে তারা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। নয়তো এই আসন নিয়ে বেচাকেনা বন্ধ হবে না।
কামাল আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়াতে হবে। তাদের সংস্কার করতে হবে, চরিত্র বদলাতে হবে। তিনি বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে শুধু আস্থা ভোট ছাড়া আর সব বিষয় তুলে দিতে হবে। সর্বদলীয় কমিশন গঠন করা হোক যার মাধ্যমে সংবিধানের বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।
গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন। তিনি বলেন, সংবিধানে প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই ন্যূনতম ঐকমত্য রাজনৈতিকভাবে অর্জন করতে হবে, যেখানে দেশের সব পক্ষের মতামত নেওয়া হবে।
ব্যারিস্টার আহাসানুল করিম বলেন, বাহাত্তরের সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করে, এই সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন নেই। সংকট তৈরি হয়েছে এর সংশোধনী নিয়ে। ধর্মনিরপেক্ষতা স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থি নয়। তাই এটি বাদ দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, সংবিধান স্বৈরাচার হয় না। স্বৈরাচার হয় ব্যক্তি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতটুকু যৌক্তিক সেটা দেখতে হবে। বিচার বিভাগের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন পদ্ধতি থাকা দরকার যাতে বিচারপতিরা সরকারের ইশারায় না চলেন।
মাসদার হোসেন বলেন, সংবিধানকে বারবার ব্যক্তিস্বার্থে সংশোধন করা হয়েছে। এখানে জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি করা হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দল চায় না বিচার বিভাগ স্বাধীন হোক।
হাসনাত কাইয়ুম বলেন, প্রায়োগিকভাবে রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে সেটা ঠিক করতে হবে। মানুষ অসাংবিধানিক বিষয়গুলোর সমাধান চায়। বিচার বিভাগকে যেন বাজেভাবে ব্যবহার করা না যায়। এখানে সংস্কার প্রয়োজন। তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। সবই করতে হবে নির্বাচিত সরকারের সংসদের মাধ্যমে।
ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, ছাত্রদের আন্দোলনে সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তনের কোনো দাবি ছিল না। এখন দেখছি প্রত্যেক ব্যক্তি সংবিধান সংশোধনের নিজস্ব নানা মত দিচ্ছেন। এটা খারাপ নয়। প্রশ্ন হলো এ ধরনের আলোচনার জন্য এটি উপযুক্ত সময় কিনা। আমার মনে হয় এটি বিতর্কের বিষয়। বরং জাতীয় নির্বাচন কীভাবে সংবিধান অনুযায়ী সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা যায় সেদিকে জোর দিতে হবে।
ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, ভবিষ্যতের সংবিধান হওয়া উচিত অন্তর্ভুক্তিমূলক। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ প্রত্যেকের মত যেন প্রতিফলিত হয়। ধর্মনিরপেক্ষতাও যেন বহাল থাকে।
সোহরাব হাসান বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানকে ভিত্তি করে আলোচ্য খসড়া প্রস্তাবনাটি করা হয়েছে। এটি সংস্কার না সংশোধন সেটা স্পষ্ট হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো, সংবিধান আমাদের একত্র করবে না, নাকি আমরা সবাই একত্রিত হয়ে সংবিধান রচনা করব– সেটা ঠিক করতে হবে।
অধ্যাপক সাইমী ওয়াদুদ বলেন, জনগণের মধ্যে কী করে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে জনগণ ঐক্যবদ্ধ না হলে রাষ্ট্রের তর্কিত অংশগুলো সমাধান হবে না। সে ক্ষেত্রে গণভোটের মাধ্যমে মতামত নেওয়া যেতে পারে।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, প্রস্তাবিত খসড়ার অনেকগুলো বিষয়ে আপত্তি রয়েছে। এটি কোনোভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে না। সাংবিধানিক আদালত সম্পর্কে যেটা বলা হয়েছে, সেটি কার্যকর করা হলে দেশে নতুন কেওয়াজ তৈরি করবে। রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার এবং সংসদ কাঠামো পুনর্বিন্যাস প্রসঙ্গে যেটা বলা হয়েছে, সেটিও কর্তৃত্ববাদ সৃষ্টি করবে।
- বিষয় :
- সংবিধান