ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

সেমিনারে বিশিষ্টজন

বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটে বিপর্যয় শিল্প খাতে

বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটে বিপর্যয় শিল্প খাতে

ছবি: সমকাল

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:১৪ | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ০১:৪২

বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে শিল্প খাতে বিপর্যয় নেমেছে। গত কয়েক মাসে কয়েকশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। রপ্তানি আয় কমেছে। বিনিয়োগ থমকে আছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এসব মন্তব্য ব্যবসায়ীদের। তারা আরও বলছেন, শিল্প খাত না বাঁচলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে। তাই শিল্পের গ্যাস-বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। শনিবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

তবে সরকার বলছে, তারা শিল্পের জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় বিশেষ জোর দিয়েছে। শিল্পাঞ্চলগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে অনুসন্ধানে জোর দেওয়া হয়েছে।

‘দেশের শিল্প খাতে জ্বালানি সংকট সমাধানের পথ’ শীর্ষক এ সেমিনার আয়োজন করে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই)। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্প খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা ও প্রতিষ্ঠানের মালিকরা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে পোশাক খাতে ৩০-৩৫ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। স্টিল কারখানায় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ২৫-৩০ শতাংশ। সিরামিক কারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। ডিজেল ব্যবহার ও শ্রমিকদের বাড়তি কাজের জন্য খরচ বেড়ে গেছে। পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন ক্ষুদ্র শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের ডিজেল জেনারেটর চালানো সম্ভব নয়। ফলে প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধের পথে। তিনি বলেন, শিল্প খাতে গাসের চাহিদা ১০০ কোটি ঘনফুটের মতো। কিন্তু এখন দেওয়া হচ্ছে ৫০ কোটি ঘনফুট। গত দুই বছরে শিল্প খাতের জ্বালানির চাহিদা বাড়েনি। 

অধ্যাপক ইজাজ বলেন, ২০৩০ সালের দিকে গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে ৪৩০ কোটি ঘনফুট। এই চাহিদা মেটাতে আমদানি করা এলএনজির ওপর বেশি নির্ভর করতে হবে। তিনি বলেন, শিল্প খাতের ভালোর জন্য জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম কমিয়ে আনতে হবে।

উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তিন মাসে জ্বালানি খাতে ৩৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ, পরিবেশ ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে আমাদের সেদিকেই এগিয়ে যেতে হবে। চলতি সপ্তাহে ৪০টি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের দরপত্র দেওয়া হবে। তিনি বলেন, পাবলিক সেক্টরে প্রতিযোগিতার অভাব রয়েছে। টিকে থাকতে হলে ঘুষ বাণিজ্য থেকে বের হতে হবে। সরকারি ক্রয়কে প্রতিযোগিতার মধ্যে আনতে হবে। 

ফাওজুল কবির বলেন, গত ১৫ বছরে বিগত সরকারের মন্ত্রী এবং সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের চুক্তিগুলো হয়েছে। এতে এই খাতে সুস্থ ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতাকে ব্যাহত করেছে। এটা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সেই অবস্থার পরিবর্তন হবে। 

তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে সখ্য করে আর ব্যবসা হবে না। যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে এই খাতে কাজ করার সুযোগ পাবেন ভালো ব্যবসায়ীরা। এতে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা হবে এবং দেশের অর্থনীতিরও প্রবৃদ্ধি হবে। এখন থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা দলীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতে কোনো চুক্তি করা হবে না। তিনি বলেন, পাইপলাইন না থাকায় ওই গ্যাস ঢাকায় বা শিল্প এলাকায় আনা যাচ্ছে না। সিএনজি ফরম্যাটে এই গ্যাস ঢাকায় আনা গেলে শিল্পে সংকট কিছুটা হলেও কমবে।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে কারখানায় গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘শিল্প কারখানায় বিনিয়োগের পর গ্যাস পেতে নিজের টাকায় ৪০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করতে হয়েছে। এই পাইপলাইন নির্মাণে শুধু রাস্তা কাটা বাবদ ২০ কোটি টাকা দিয়েছি। এর বাইরে আরও অতিরিক্ত অনেক টাকা দিতে হয়েছে আমাকে।’ 

তিনি বলেন, গ্যাসের জন্য সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর (নসরুল হামিদ) বাসার সামনে আমাকে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে অনেক লেকচার শুনতে হয়েছে। মিনিমাম ইজ্জত পর্যন্ত পাইনি। তার পরও জি স্যার, জি স্যার বলতে হয়েছে। কিছু কিছু মানুষের সিটি স্ক্যান করে তাদের ব্রেইন দেখার ইচ্ছা হচ্ছে আমার। মানুষ কীভাবে এত ক্রিমিনাল হতে পারে। 
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, এখন ব্যবসায়ীদের কোনো চাঁদা কিংবা ঘুষ দিতে হবে না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সৎ উদ্যোক্তাদের দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে অবদান রাখার বিরাট সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, ‘কিছুদিন আগে একজন ব্যবসায়ী আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি তাঁর টেক্সটাইল কারখানা আংশিক বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মাগরিবের নামাজের সময় আমার ডান পাশে ছিলেন। সিজদায় গিয়ে হুহু করে কান্না। তিনি আসলে গ্যাসের চাপ পাচ্ছিলেন না। কারখানা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংকের টাকা দিতে পারছেন না। নরসিংদী এলাকায় অনেক কারখানা রুগ্‌ণ হয়ে যাচ্ছে জ্বালানি সংকটে।’

তিনি বলেন, আমরা অনেকে কারখানা চালাতে পারছি না। কারণ যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে তাদের শ্রমিকরা এসে ভাঙচুর করছে, চাকরি চায়। আমরা তাদের কীভাবে চাকরি দেব, আমরাই তো কারখানা চালাতে পারছি না।

এ. কে. আজাদ বলেন, জ্বালানি উপদেষ্টার কাছে কয়েক দিন আগে গিয়েছিলাম। তিনি ব্যাপারটা বোঝেন, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছেন। এখন একটু ভালো অবস্থায়, এভাবে গ্যাস পেলে উৎপাদন চালিয়ে নিতে পারব, কিন্তু টিকে থাকতে পারব না। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জ্বালানির দাম বাড়ছে, শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে না। কারণ পাকিস্তান কম দামে পণ্য দিতে পারছে। আমাদের রপ্তানি যেখানে নেতিবাচক, সেখানে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ভালো। ভারতের ৬টা প্রদেশ শ্রমিকদের বেতনে ভর্তুকি দেয় বিনিয়োগকারীদের। জমি বিনামূল্যে, বিদ্যুৎ-জ্বালানিতেও ভর্তুকি দেয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা সেখানে ছুটছে। আমরা ব্যবসা টিকাতে পারছি না। আপনি গ্যাস দেন, আপনাকে বৈদেশিক মুদ্রা দেব।

তিনি বলেন, আমি যুক্তরাষ্ট্রের কটন সামিট থেকে ফিরলাম। সেখানে একজন অর্থনীতিবিদ দেখালেন চীনের ওপর যেভাবে কর আরোপ করা হচ্ছে, তাতে আমদানিকারকরা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম– এসব দেশে আসছে। কিন্তু আমরা অর্ডারগুলো সেভাবে নিতে পারছি না। কারণ সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করতে পারছি না। ডিজেল দিয়ে উৎপাদন চালু রাখা সম্ভব না। সরকার যদি শিল্পাঞ্চলগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ায়, তাহলে কর্মসংস্থান বাড়বে, রাজস্ব আয় বাড়বে। প্রয়োজনে একবেলা খাবার রান্না করে তিন বেলা গরম করে খাব। গাড়িতে গ্যাস পোড়ায় লাভ কি হয়?

এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, প্রতিবছর কমপক্ষে ১৫-১৫ লাখ লোক চাকরির বাজারে আসছে। পাশাপাশি কৃষি থেকে কর্মচুত্য হয়ে এক বড় সংখ্যক শ্রমিক বেকার হচ্ছে। কারণ কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এ দুটিকে একত্র করলে বছরে কমপক্ষে ২৫ লাখ লোক চাকরির বাজারে আসছে। এসব লোকের কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন শিল্পায়ন। আর এ জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিদ্যুৎ-গ্যাস। এ দুটিতে সমস্যা হলে কর্মসংস্থান হবে না। মূল্যস্ফীতি বাড়বে।

এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, শিল্পাঞ্চলগুলো, বিশেষ করে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ময়মনসিংহে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দিতে হবে। দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে এদিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।

বিসিআইর সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী অনুষ্ঠানে বলেন, শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি দিন দিন কমছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে কমে হয় ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত এপ্রিল থেকে জুন মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ।  জ্বালানি সংকটের কারণে এ বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২০০টি শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, আরও ৩০০টি কারখানা ঝুঁকিতে রয়েছে।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি সংকটে বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি আগস্ট, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ কমেছে। বিদেশি বিনিয়োগ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০২২-২৩ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার কমেছে। বিপরীতে গ্যাসের দাম গত ৫ বছরে ২৮৬ শতাংশ বেড়েছে। যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ ৪১ শতাংশ কমেছে, কাঁচামালে কমেছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আগে সরকারের ওপর মহল থেকে শিল্প খাতকে বঞ্চিত করে বিদ্যুতে বেশি গ্যাস দিতে বলা হতো। এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। আমরা শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়েছি।  আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ভোলা থেকে গ্যাস আনার টেন্ডার আহ্বান করা হবে। এ ছাড়া ৯ ডিসেম্বর অফশোর বিডিং টেন্ডার খোলা হবে। আগামী বছরের শুরুতেই বিশ্বের নামকরা জ্বালানি কোম্পানির সঙ্গে অফশোরের গ্যাস নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হবে বলে আশা করি।

তিনি বলেন, পার্বত্য এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা আছে। এসব এলাকার গ্যাস অনুসন্ধানে অফশোর বিডিং ওপেন করার প্রস্তুতি চলছে। আশা করছি, আগামী মার্চের মধ্যে অফশোর বিডিং করা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন

×