৩৬% পরিবারে ৪৫৪০ টাকা মাসিক ভাতা প্রয়োজন

.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:৫১
সবার জন্য ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিতে প্রায় ৩৬ শতাংশ পরিবারকে প্রতি মাসে ৪ হাজার ৫৪০ টাকা নগদ ভাতা দেওয়া প্রয়োজন। দারিদ্র্য ও আয়বৈষম্য কমাতে এ জন্য বছরে সরকারের ব্যয় হবে ৭৫ হাজার কোটি টাকা; যা চলতি বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দের প্রায় ৫৪ শতাংশ। এ পদ্ধতিতে নাগরিকদের মৌলিক আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব বলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
গতকাল রোববার রাজধানীর লেকশোর হোটেলে আয়োজিত এক সংলাপে ‘সর্বজনীন মৌলিক আয়ের উপযোগিতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির সিনিয়র গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। সংলাপে সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বজনীন মৌলিক আয় নিশ্চিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানাভাবে দরিদ্র নাগরিকদের সহায়তা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাস্তবায়ন ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে মৌলিক আয় পূরণে একটি অংশ সরকার থেকে দেওয়া। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতি পরিবারের ন্যূনতম আয়, দারিদ্র্য ও অসচ্ছলতাসহ দশটি সূচকের ভিত্তিতে ১০০ নম্বরের মধ্যে শহরাঞ্চলে ৪৮ এবং গ্রামাঞ্চলে ৫২ নম্বরের নিচের পরিবারকে এ ধরনের সুবিধার আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন মৌলিক আয় নিশ্চিতে প্রতিটি পরিবারকে
মাসে ৪ হাজার ৫৪০ টাকা দেওয়া প্রয়োজন। গবেষণায় উঠে এসেছে যে, সারাদেশে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হলে মোট পরিবারের ৩৫ দশমিক ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ১ কোটি ৪৭ লাখ ২৫ হাজার পরিবারকে এ অর্থ দিতে হবে।
সিপিডি বলছে, এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হলে শিক্ষা ও কৃষি খাতে ভর্তুকি ছাড়া অন্যান্য সাধারণ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির প্রয়োজন হবে না। এতে করে সরকারের একটি বিশাল অর্থ সাশ্রয় হবে। ফলে নতুন কর্মসূচি বাস্তবায়নে খুব বেশি বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে উপকারভোগী নির্বাচনে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে যারা পাওয়ার কথা তারা পায় না, আবার অনেকে যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও পায়। নতুন পদ্ধতিতে এ সমস্যা কটিয়ে ওঠা সম্ভব। সার্বিকভাবে সারাদেশে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ দারিদ্র্য কমানো সম্ভব। দারিদ্রপ্রবণ, জলবায়ু ঝুঁকি ও উচ্চ দারিদ্রপ্রবণ জেলাগুলো এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৭২, ৩ দশমিক শূন্য ৭ এবং ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ দারিদ্র্য কমানো যাবে।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম (ইউবিআই) নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু হয় ১৯৮০ সালের দিকে। তবে বাংলাদেশে আলোচনার টেবিলে আসতে চার দশক সময় লেগেছে। এখন নতুন সময়। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইউবিআই আর একাডেমিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ নেই, বরং গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। এতদিন যে প্রক্রিয়া চলেছে, তাতে দারিদ্র্য পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হয়নি। বৈষম্যের ধারাকেও শ্লথ করা যায়নি। বর্তমানে ১৪০টির মতো বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থাকলেও এগুলোকে রাজনৈতিক সুবিধা বিতরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আগামী দিনে নৈতিকভাবে সঠিক, পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই, প্রতিষ্ঠানিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য একীভূত ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আধুনিক চিন্তাধারায় সব নাগরিককে ন্যূনতম আয় দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি পরিবারকে মাসে ৪ হাজার ৫৪০ টাকা দিলে তা হবে গ্রহণযোগ্য একটা অবস্থা। এটা যদি একসঙ্গে সারাদেশে বাস্তবায়ন করা না যায়, তাহলে ধাপে ধাপে উদ্যোগ নিতে হবে।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে দেশের উন্নয়নে যে কোনো কিছু করা সম্ভব জানিয়ে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। স্বচ্ছতার অভাব দূর করে সমন্বয় করা গেলে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যায়। গত ১৬ বছর এমন এমন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে, যেখান থেকে কোনো রিটার্ন আসেনি।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করলে এ ধরনের ভাবনার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এসব ক্ষেত্রে মানুষকে যখন সরকার থেকে টাকা দেওয়া হয়, তখন এর ইতিবাচক প্রভাব সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে পড়ে। চাহিদা বাড়ার ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও সহায়তা করে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, ইউবিআই যেসব দেশে আছে, সেখানে কর-জিডিপির অনুপাত অন্তত ১০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশের মতো নিম্ন কর-জিডিপির দেশে অর্থায়ন বেশ কঠিন। একই সঙ্গে অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ তো আছেই। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এর একটা রোডম্যাপ তৈরি করতে পারে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সোশ্যাল প্রটেকশন ডেলিগেশন প্রোগ্রাম ম্যানেজার লোলে ভ্যালেনটিনা, বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র সোশ্যাল প্রটেকশন অর্থনীতিবিদ আনিকা রহমান প্রমুখ।
- বিষয় :
- ভাতা