ঢাকা বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বাল্যবিয়ে রোধে সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা জরুরি

ওয়ার্ল্ড ভিশন-এসএসবিসি প্রকল্প-সমকাল গোলটেবিল আলোচনা

বাল্যবিয়ে রোধে সামাজিক  ও আর্থিক নিরাপত্তা জরুরি

রাজধানীর গুলশান-তেজগাঁও লিঙ্ক রোডে ওয়ার্ল্ড ভিশনের জাতীয় কার্যালয়ে রোববার গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা -সমকাল

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৪

বাল্যবিয়ে রোধে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও মেলেনি কাঙ্ক্ষিত ফল। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না থাকা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি এর বড় কারণ। শিশুদের জন্য যে ধরনের পারিবারিক, সামাজিক এবং শিক্ষার পরিবেশ দরকার, অনেক ক্ষেত্রেই তা নেই। এ ছাড়া নারী-পুরুষ বৈষম্যের বিবেচনায়ও বাংলাদেশ পিছিয়ে। বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করতে প্রয়োজন মেয়েদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা।

গতকাল রোববার রাজধানীর গুলশান-তেজগাঁও লিংক রোডে ওয়ার্ল্ড ভিশনের জাতীয় কার্যালয়ে ‘বাল্যবিয়ে এবং শিশুর প্রতি সহিংসতা: প্রেক্ষিত ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলা হয়। সমকাল, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এবং স্ট্রেংদেনিং সোশ্যাল অ্যান্ড বিহেভিয়ার চেঞ্জ প্রকল্প (এসএসবিসি) যৌথভাবে এই আয়োজন করে। এই প্রকল্প ইউনিসেফ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলায় চলমান। 

সমকালের সহযোগী সম্পাদক শেখ রোকনের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক, ইউনিসেফের সোশ্যাল অ্যান্ড  বিহেভিয়ার চেঞ্জ অফিসার সেতারায়ে জান্নাত, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের সিনিয়র ডিরেক্টর (অপারেশনস) চন্দন জেড গমেজ, গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার সেকেন্ড সেক্রেটারি (ডেভেলপমেন্ট) স্টিফানি সেন্ট-লরেন্ট ব্রাসার্ড, ফিল্ড সাপোর্ট সার্ভিস প্রজেক্টের জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড উইমেন্স এম্পাওয়ারমেন্ট টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট তাছলিমা আক্তার, ইউএসএআইডির ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যান্ড রিপ্রডাক্টিভ হেলথ স্পেশালিস্ট ডা. ইশরাত নায়ার, ইউনিসেফের চাইল্ড প্রটেকশন অফিসার জেসমিন হোসেন, প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট ফারজানা ফেরদৌস, দৈনিক ইত্তেফাকের স্টাফ রিপোর্টার রাবেয়া বেবী, ঋতু হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান উম্মে শারমিন কবীর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নাসরিন আখতার, গাইবান্ধার পশ্চিম কুপতলা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদা খাতুন, বাংলাদেশ ইমাম পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক ওসমান গণি, কুড়িগ্রামের পাইকের ভিটা জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মো. আ. কাইয়ুম সিরাজী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনিরুদ্ধ যুব ফোরামের ইয়ুথ লিডার সামিউল ইসলাম অপূর্ব।

স্বাগত বক্তব্য দেন ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের ন্যাশনাল ডিরেক্টর সুরেশ বার্টলেট। এসএসবিসি প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন ওয়ার্ল্ড ভিশনের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার সিলভী পিংকী চক্রবর্ত্তী। সমাপনী বক্তব্য দেন ইউনিসেফের এসবিসি অফিসার মনজুর আহমেদ এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ওয়ার্ল্ড ভিশনের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনী মিলফ্রেড ডিক্রুজ।
এ ছাড়া অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন  ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচির ব্যবস্থাপক জয়শ্রী সরকার, বি-স্ক্যানের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব, রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনালের হেলথ কমিউনিকেশনের ডিরেক্টর ডা. ফারহানা হক, হোপ ফর পুওরেস্টের ইফতেখার আহমেদ খান, সিমাভী-নেদারল্যান্ডসের সাবিহা সিদ্দিকী, ঢাকা ট্রিবিউনের সাংবাদিক নওয়াজ ফারিন অন্তরা প্রমুখ।  
অনুষ্ঠানে আবু সাঈদ খান বলেন, যেসব অঞ্চল আর্থিকভাবে পিছিয়ে, সেই অঞ্চলগুলোতে বাল্যবিয়ে বেশি। কাজেই এসব পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বাল্যবিয়ের বড় কারণ ধর্মীয় গোঁড়ামি। এ ক্ষেত্রে দেশের আলেম সমাজ বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সমাজে নারী এখনও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে আছে। নারীর মধ্যে মর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। এর জন্য সাংস্কৃতিক জাগরণ দরকার। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেন কাজিরা। তাই আইনের বাস্তবায়ন জরুরি।

সুরেশ বার্টলেট বলেন, সব শিশু যেন শিক্ষার আলো পায় এবং নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে– এ নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। আমি যখন দেশের শিশু ও যুবসমাজের সঙ্গে কথা বলি এবং তাদের স্বপ্নের কথা জানতে পারি, তখন অভিভূত হই। আমাদের দায়িত্ব তাদের স্বপ্ন পূরণে কাজ করা। 

তানিয়া হক বলেন, অনেকে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে কাজ করলেও একটা শ্রেণি আছে, যারা বাল্যবিয়ের পক্ষে। তারা এক এলাকায় বাল্যবিয়ে না দিতে পারলে অন্য এলাকায় গিয়ে দিচ্ছে। আমাদের সমন্বিত পরিবারিক নীতিমালা এখনও হয়নি। এটি করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে শুধু বাবা-মা নন, সবাইকে যোগ্য অভিভাবক হতে হবে।  
সেতারায়ে জান্নাত বলেন, বাল্যবিয়ে একটা সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। বাবা-মা, শিক্ষক, কমিউনিটি লিডার, ধর্মীয় নেতা– সবাইকে এ বিষয়ে একত্রে কাজ করতে হবে। 

চন্দন জেড গমেজ বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে নীতিমালা সংস্কার করা দরকার। প্রয়োজনে মেয়েশিশুদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ায় এ বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 
স্টিফানি সেন্ট-লরেন্ট ব্রাসার্ড বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে সমাজের সব পক্ষকে ভূমিকা রাখতে হবে। নেটওয়ার্ক তৈরি করে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করা জরুরি। বাল্যবিয়ে রোধে আমরা এগিয়েছি এটা সত্য, তবে এখনও অনেক কাজ বাকি। এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। 
সিলভী পিংকী বলেন, সমাজের সব স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে এবং তাদের মধ্যকার পার্টনারশিপ শক্তিশালী করতে পারলে বাল্যবিয়ে কমিয়ে আনা সম্ভব। 
রাবেয়া বেবী বলেন, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক কারণে বাল্যবিয়ে বেশি হয়। এ ছাড়া ধর্মীয় কারণেও অনেকে কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেন। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে প্রচার জোরদার করতে হবে। 

শারমিন কবীর বলেন, কিশোরীদের সঠিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের সম্পর্কে জানতে পারে এবং নিজেদের ব্যাপারে সতর্ক থাকে। একই সঙ্গে মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে বাল্যবিয়ে অনেক কমে যাবে।
নাসরিন আখতার বলেন, বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। এটি রোধে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে শিক্ষা। শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে। তারা সচেতন হলে নিজেরাই বাল্যবিয়ে রোধ করতে পারবে।

মাহমুদা খাতুন বলেন, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহযোগিতার জন্য একটা তহবিল গঠন করা প্রয়োজন। এটি করা গেলে শিক্ষাঙ্গন থেকে শিশুদের ঝরে পড়া এবং বাল্যবিয়ে অনেকটা কমে আসবে। 
ওসমান গণি বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে আমাদের সামাজিক পরিবর্তন প্রয়োজন। মেয়েদের জন্য যদি ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বাল্যবিয়ে কমবে।
আবদুল কাইয়ুম সিরাজী বলেন, বাল্যবিয়ের মতো ব্যাধি সমাজ থেকে একেবারে নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত কাজ করতে হবে। এ ছাড়া শিশুদের শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রাখা যাবে না।
সামিউল ইসলাম অপূর্ব বলেন, আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার কাজ করছি। যাতে ভিকটিমরা আমাদের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। অন্যদিকে, এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখি। তাদের সঙ্গে রাখতে পারলে বাল্যবিয়ে রোধ ও মানুষকে সচেতন করতে সহজ হয়।

 


 

আরও পড়ুন

×