ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঢাকায় সরবরাহ থাকলেও বিভিন্ন জেলায় ‘সংকট’

ঢাকায় সরবরাহ থাকলেও বিভিন্ন জেলায় ‘সংকট’

কোলাজ

 সারওয়ার সুমন ও জসিম উদ্দিন বাদল

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:৪৫ | আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১০:৫১

ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়ানো ও দাম স্বাভাবিক রাখতে দুই দফায় আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) কমিয়েছে সরকার। এতে বোতলজাত ও খোলা উভয় ধরনের তেলের দাম লিটারে ১০ থেকে ১২ টাকা কমার কথা। তবে কমেছে ৫ থেকে ৬ টাকা। ভ্যাট ছাড়ের সুফল আমদানিকারকরা পেলেও পুরোপুরি পাচ্ছেন না ভোক্তা। এদিকে বাজারে বোতলজাত তেলের চেয়ে খোলা তেলের দাম বেশি। এতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বোতলের তেল ঢেলে খোলা অবস্থায় বিক্রি করছেন। কোথাও অন্য পণ্য কেনার শর্তে মিলছে তেল। বাজারজাতকারীরা সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় দেশের কোথাও কোথাও বোতলজাত তেল এক প্রকার হাওয়া হয়ে গেছে। ঢাকায় বড় বাজার ও সুপারশপগুলোতে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও এলাকাভিত্তিক ছোট বাজার ও মহল্লায় বোতলজাত তেলের সরবরাহ কম। 

অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৭ অক্টোবর অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, পরিশোধিত পাম অয়েল ও সয়াবিন বীজ– এই তিন পণ্য আমদানিতে ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করে। এর পর ১৯ নভেম্বর স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে আরও ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়। ফলে শুধু আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট থাকল। কিন্তু ভ্যাট কমার প্রভাব নেই বাজারে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে গত আগস্টে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ১২৭ থেকে ১৩০ টাকায়। গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ১৬৭ থেকে ১৭৫ টাকায়। অর্থাৎ, তিন মাসে কেজিতে বেড়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। পাইকারিতে দর বেশি থাকায় খুচরায় এর প্রভাব পড়েছে। 

গত শনি ও রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী কাঁচাবাজার ও নাখালপাড়া সমিতির বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা। তবে নির্ধারিত দরেই, অর্থাৎ ১৬৭ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে বোতলজাত সয়াবিন তেল। এ ছাড়া খোলা পাম অয়েল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬৮ থেকে ১৭০ টাকায়। দিন দশেক আগেও এসব তেলের এমন দরই ছিল। দেশের অন্যান্য জেলায় দর আরও বেশি। গতকাল কুমিল্লা ও বরিশালে কেজিপ্রতি খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকা। বোতলজাত তেল প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা। অথচ তেলের বোতলে লেখা আছে সর্বাচ্চ খুচরা মূল্য ১৬৭ টাকা। বোতলজাত তেল লিটার হিসেবে বিক্রি হলেও খোলা তেল বিক্রি হয় কেজি হিসেবে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম প্রায় ৭ শতাংশ ও পাম অয়েলের দাম ৬ শতাংশ বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে এই হার আরও বেশি।

রাজধানীর তেজকুনিপাড়ার মায়ের দোয়া স্টোরের স্বত্বাধিকারী হেলাল উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘কোম্পানি গায়ে লেখা দরে বোতলজাত তেল দিচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি সম্ভব নয়। সে জন্য বোতল রাখা বাদ দিয়েছি। তবে খোলা তেলের দর কিছুটা কমেছে।’ 

পাইকারি ব্যবসায়ীরা দুষছেন আমদানিকারকদের

খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আমদানিকারকরা চাহিদামতো তেল সরবরাহ করছেন না। তবে আমদানিকারক ও বাজারজাতকারীদের দাবি, চাহিদার তুলনায় আমদানি কম, বিশ্ববাজারে দাম বেশি, ডলারের দামে অস্থিরতা, ঋণের সুদ হার বৃদ্ধি এবং শীর্ষ আমদানিকারকদের কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় থাকায় ভোজ্যতেলের বাজারে স্বস্তি ফিরছে না। তারা বলছেন, মূলত বিশ্ববাজারে দর বাড়ার কারণে দেশে দাম স্থির রাখতে সরকার ভ্যাট কমিয়েছে। ফলে নতুন করে দাম বাড়েনি।

তবে সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন, ব্যবসায়ীদের এসব দাবি অজুহাত মাত্র। এখন যে তেল বিক্রি হচ্ছে, তা আমদানি হয়েছে তিন থেকে ছয় মাস আগে। তখন বিশ্ববাজারে তেলের দর অনেক কম ছিল। এখন বিশ্ববাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও সেই তেল আমদানি করে পরিশোধনের পর বাজারে আসবে আরও কিছুদিন পর।

ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২২ লাখ টন। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ২ লাখ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি করা হয়েছে ২৩ লাখ টন। 

বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি আবুল হাসেম সমকালকে বলেন, প্রথম দফায় ভ্যাট কমানোর পর বাজারে তেমন প্রভাব পড়েনি। দ্বিতীয় দফায় কমার পর মিলাররা প্রতি মণে ৫০০ টাকার মতো কমিয়েছেন। দুই দফায় ভ্যাট কমার কারণে লিটারে ১২ থেকে ১৩ টাকা কমার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে খুচরা পর্যায়ে দাম কমছে না। পাইকাররা যে দরে মিলারদের কাছে তেল পাওয়ার কথা, সেই দরে পাননি এতদিন। তবে এখন কিছুটা কম দরে পাওয়া যাচ্ছে। 

খাতুনগঞ্জে ভোজ্যতেলের বড় ব্যবসায়ী আরএম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বধিকারী  আলমগীর পারভেজ জানান, ভ্যাট কমানোর পর তেলের দাম আস্তে আস্তে কমছে। গত সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে কেজিপ্রতি পাম অয়েলের দাম ৮ থেকে ১০ টাকা ও সয়াবিনের দাম ৫ থেকে ৬ টাকা কমেছে। পাম অয়েলের দাম গত সপ্তাহে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ৬ হাজার ৩৬০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৬০ টাকা।মণপ্রতি কমেছে ৩০০ টাকা। আর সয়াবিন মণপ্রতি কমেছে ২০০ টাকা। গত সপ্তাহে ৬ হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া সয়াবিনের মণ এখন কেনা যায় ৬ হাজার ৪৫০ টাকায়।

আমদানিকারকদের নানা অজুহাত

এ ব্যাপারে বসুন্ধরা মাল্টি ফুড অ্যান্ড প্রডাক্টের বিভাগীয় প্রধান (বিক্রয় ও বিপণন) রেদোয়ানুর রহমান বলেন, আমাদের উৎপাদন কার্যক্রম চলমান। খোলা অবস্থায় নয়, সব তেল বোতলজাত করে বাজারে বিক্রি করা হয়। তাই বাজারে সরবরাহ না করলে পণ্য থেকে যাবে। আমাদের আমদানি কমেছে। সে জন্য বাজারে সরবরাহ কিছুটা কম থাকতে পারে।

সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম এখন বেশি। যখন কম ছিল, তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল দেশে। তাই এটির সুফল পাইনি আমরা। তা ছাড়া এলসি খুলতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। ডলারের দামও অস্থির কয়েক বছর ধরে। এ জন্য আমদানি কমেছে। এর প্রভাব আছে বাজারে।’ 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি কোম্পানির এক পরিচালক সমকালকে জানান, এস আলমের কারখানায় উৎপাদন বন্ধ। তাদের ৪০-৫০ হাজার টন অপরিশোধিত তেল রয়েছে গোডাউনে। সরকার এই তেল নিয়ে বিক্রি করে দিলে চলমান ঘাটতি দূর হবে।

বিশ্ববাজারে দর কত 

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (মার্চ পর্যন্ত) বিশ্ববাজারে প্রতিটন সয়াবিন তেলের দর ছিল ৯৮০ ডলার। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল থেকে জুন) কিছুটা বেড়ে হয় ৯৮৬ ডলার। তবে জুলাইয়ে দর বেড়ে হয় ১ হাজার ৭৯ ডলার। আগস্টে কিছুটা কমে নেমে আসে ১ হাজার ৩১ ডলারে। এর পর দাম বাড়তে থাকে ধারাবাহিকভাবে। আমদানিকারকদের দাবি, এ সময়ে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের মূল্য ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং পাম অয়েলের মূল্য ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়েছে।

আমদানি কমেছে

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ৯ লাখ ১৯ হাজার ৭৯ টন সয়াবিন এবং পাম অয়েল আমদানি হয়। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার ২৩০ টন।

আমদানির তুলনায় বেশি দরে বিক্রি

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এলসি খোলার দুই-তিন মাস পরে তেল আসে দেশে। সেটি বন্দরে আসার পর প্রক্রিয়াজাত করতে নেওয়া হয় কারখানায়। সেখান থেকে প্রস্তুত হয়ে বাজারে আসে। এসব প্রক্রিয়ায় তিন-চার মাস লেগে যায়। তিনি বলেন, যখন দাম কমে তখন বিভিন্ন অজুহাত দেখান ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশে বাড়ানোর জন্য ক্রমাগত চাপ দেন তারা। কখনও কখনও আমদানি কমিয়ে দেন। কখনও সরবরাহ কমিয়ে দেন। বাজারে আসলে হচ্ছেটা কী, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমদানি প্রক্রিয়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার অবনমন একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। কেউ কেউ অনেক ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক দরেও পণ্য কিনতে পারছে না। সে জন্য সরকার কিছু ছাড় দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা নৈতিকভাবে বিষয়টি বিবেচনা করলে দাম কিছুটা হলেও সহনীয় হওয়ার কথা।’ 
 
বরিশাল-কুমিল্লায় বোতলজাত তেল ‘উধাও’

বরিশাল ও কুমিল্লার বাজার থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেল ‘উধাও’ হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ ধরে বরিশালের বেশির ভাগ পাইকারি কিংবা খুচরা ব্যবসায়ীর কাছে ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। খোলা সয়াবিন তেল খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ২০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। বোতলজাত তেলের দাম কম হওয়ায় বোতল থেকে ঢেলে খোলা হিসেবে বিক্রি করছেন অনেক অসাধু ব্যবসায়ী। নগরের চকেরপুলের প্রিন্স স্টেশনারির কর্মচারী তানভীর মাহমুদ ইমন বলেন, গত বুধবার থেকে স্থানীয় পরিবেশকরা সয়াবিন সরবরাহ করছেন না। হাটখোলা নিউ শ্রীকৃষ্ণ ভান্ডারের মালিক জানান, ৫ লিটারের বোতলের দাম পড়বে ৮৫০ টাকা, অথচ এর নির্ধারিত দর ৮১৮ টাকা। নগরের প্যারারা রোডের দোকানি মারুফ হোসেন বলেন, ১০-১২ দিন ধরে বোতলজাত সয়াবিনের সংকট। কোম্পানিগুলো বোতলজাত তেল দিচ্ছে না।

কুমিল্লায় পাইকারি তেলের বাজার রাজগঞ্জ, চকবাজার ও নিউমার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, কিছু দোকানে বোতলজাত তেল মিললেও প্রতি লিটারে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশি নিচ্ছেন বিক্রেতারা। আবার কিছু ব্যবসায়ী অধিক লাভের আশায় গোপনে বোতলের মুখ খুলে খোলা অবস্থায় বিক্রি করছেন কেজি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা দরে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজগঞ্জ বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, এক লিটারের বোতলজাত তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬৭ টাকায়। এই তেলের বোতল খুলে বিক্রি করলে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেশি লাভ থাকে। নগরীর চকবাজার এলাকার শংকর স্টোরের মালিক রনি সাহা বলেন, এক সপ্তাহ ধরে বোতলজাত তেলের সরবরাহ নেই।

চাল-ডাল না কিনলে মিলছে না তেল

ঝিনাইদহের শৈলকুপা বাজার থেকে হঠাৎ উধাও বোতলজাত সয়াবিন তেল। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোম্পানির চাল, ডাল, সুজি, হলুদ না নিলে বোতলজাত সয়াবিন দিচ্ছেন না ডিলাররা। তবে ডিলাররা বলছেন, বোতলজাত তেলের দাম কম হওয়ায় ব্যবসায়ীরা বোতলের তেল ব্যারেলে ঢেলে বেশি দামে বিক্রি করছেন। বাজারের মুসলিম স্টোরের মালিক ডাবলু জানান, এক কেজি খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা। বোতলজাত তেল বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ১৬৭ টাকা। তবে কোম্পানির অন্যান্য পণ্য না নিলে মিলছে না বোতলের সয়াবিন।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন বরিশাল ব্যুরো এবং কুমিল্লা ও শৈলকুপা প্রতিনিধি)

আরও পড়ুন

×