ঢাকা বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

মামলার ফাঁদ পেতে চলছে ‘বন্ধ হওয়া’ বিশ্ববিদ্যালয়

মামলার ফাঁদ পেতে চলছে  ‘বন্ধ হওয়া’ বিশ্ববিদ্যালয়

.

 সাব্বির নেওয়াজ

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:২৭

কুইন্স ইউনিভার্সিটি ১৯ বছর আগে বন্ধ করে দেয় সরকার। একই সময়ে বন্ধ করা হয় আমেরিকা-বাংলাদেশ (আমবান) ইউনিভার্সিটি এবং দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা। এক যুগ আগে উচ্চ আদালতের নির্দেশে বন্ধ করা হয় দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। বন্ধের নির্দেশ পেলেও আদতে এসব প্রতিষ্ঠানে তালা পড়েনি। বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্পাস খুলে সচল রেখেছে শিক্ষার্থী ভর্তি। চলছে সনদ বাণিজ্যও। বিশ্ববিদ্যালয় চালু রাখতে তৈরি করা হয় ‘মামলার ফাঁদ’।
কুইন্স, কুমিল্লা ও আমবান মাঝে এক বছরের জন্য পরিচালনার অনুমতি পেয়েছিল আদালতের। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে পারেনি তারা।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধে সরকার ও আদালতের নিষেধাজ্ঞা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে একের পর এক রিট করেই যাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। ইউজিসির চেয়ারম্যান ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিবাদী করে এসব মামলা করা হয়। এখন এ ধরনের মামলার সংখ্যা অন্তত ৩৪। কোনো মামলায় উচ্চ আদালতের আদেশ বিপক্ষে গেলে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আবার আপিলের শুনানি বছরের পর পিছিয়ে দিয়ে অনেকটাই নির্বিঘ্নে ‘বন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়’ সচল রাখছে তারা।

ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, ইউজিসি কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলেও উচ্চশিক্ষার দেখভালকারী এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দফায় দফায় আদালত অবমাননার মামলা দেওয়া হয়। কয়েক বছর আগে আমবান কর্তৃপক্ষ ইউজিসির বিরুদ্ধে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করে। এসব কারণে দুর্বল ইউজিসি ভীত হয়ে পড়ে। তারা জোরালো কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে প্রতিবছর এইচএসসির ফল প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি মৌসুমে শুধু একটি গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায় সারে। 
ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মো. মহিবুল আহসান বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে প্রতিবছরই আমরা গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকি। ‘কেন স্থায়ীভাবে এসব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা যাচ্ছে না’– প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বন্ধ করার এখতিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।  মামলা-মোকদ্দমা থাকায় বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন পরিচালকের প্রভাবে দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লাকে নানা সুবিধা দিতে বাধ্য হতে হয়েছে মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি। সূত্র জানায়, আমবান ইউনিভার্সিটিতে দুটি গ্রুপ। বিগত সরকারের আমলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের গ্রুপ শক্তিশালী ছিল। সরকার বদলের পর আবু মুসা গ্রুপ দাপট দেখাচ্ছে সর্বত্র।
শিক্ষার্থীরা যাতে ফাঁদে পড়ে নামসর্বস্ব বা অনুমোদনহীন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হন, সেজন্য গত বৃহস্পতিবার সতর্কতামূলক গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ইউজিসি। সংস্থাটি আটটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো– ইবাইস ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ঢাকা), সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুইন্স ইউনিভার্সিটি। এগুলোতে ভর্তি হয়ে প্রতারিত কিংবা পরে কোনো সমস্যা  হলে এর দায় ইউজিসি নেবে না। ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক ড. সুলতান মাহমুদ ভূঁইয়া কথা বলতে রাজি হননি। 

গভীর সংকটে আট বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি থেকে জানা গেছে, আইনকানুনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না ইবাইস ইউনিভার্সিটি। তাদের সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদও উত্তীর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রমের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। জানা গেছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়ে ড. জাকারিয়া লিঙ্কন ও শওকত আজিজ রাসেলের মধ্যে মামলা চলছে। 
সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতেও। এই ইউনিভার্সিটির একাডেমিক, প্রশাসনিক, আর্থিক, ভর্তি, পরীক্ষা ও ফল এবং একাডেমিক সনদের আইনি কোনো বৈধতা নেই।
একই অবস্থা দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লারও। এটিরও একাডেমিক, প্রশাসনিক, আর্থিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি, পরীক্ষা ও ফল এবং প্রদত্ত একাডেমিক সনদের বৈধতা নেই। অন্যদিকে, নির্ধারিত সময়ে স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষাসহ সব কার্যক্রম স্থানান্তরে ব্যর্থ হওয়ায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকার ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রেখেছে কমিশন। 
রাজধানীর সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে বর্তমানে ভাইস চ্যান্সেলর নেই। ট্রেজারার নিয়োগ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় মনোনীত অডিট ফার্মের মাধ্যমে অডিট করা হয়নি। সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের নামে একাধিক মামলা আদালতে বিচারাধীন। 
আদালতের আদেশে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর সব বহিঃক্যাম্পাস এক যুগ আগে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃক্যাম্পাস বন্ধ করা হয়। আর কুইন্স ইউনিভার্সিটি ২০০৬ সালে বন্ধ করার পর পরবর্তী সময় বাতিল-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন শর্তসাপেক্ষে এক বছরের জন্য প্রত্যাহার করা হয়েছিল। 
এসব বিষয়ে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, আট বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে ইউজিসির গৃহীত এই ব্যবস্থা সাময়িক এবং সতর্কতামূলক। যদি তারা তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে ১১৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ১০৬ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্যগুলো নতুন।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×