ঢাকা শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

অভ্যুত্থানের রক্তস্নাত বাংলাদেশে এলো বিজয়ের মাস

অভ্যুত্থানের রক্তস্নাত বাংলাদেশে এলো বিজয়ের মাস

প্রতীকী ছবি

আবু সাঈদ খান

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:১২ | আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৮:৫৪

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের রক্তস্নাত বাংলাদেশে এলো বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। একাত্তরের লাখো শহীদের রক্তের ধারায় আবু সাঈদ-মুগ্ধদের শোনিত ধারা আজ একাকার।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর কাছে। ৯ মাসের যুদ্ধে অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিল, দুই লাখ নারী নির্মম নির্যাতনের শিকার হলো, এক কোটি নর-নারীকে প্রতিবেশী ভারতে শরণার্থী হতে হলো। মুষ্টিমেয় আলবদর, রাজাকার, শান্তি কমিটি ছাড়া সব মানুষ যুদ্ধে শামিল হলো; তরুণরা অস্ত্র হাতে তুলে নিল; শিল্পীরা গানে গানে অনুপ্রেরণা জোগাল; কৃষকের পর্ণকুটির পরিণত হলো মুক্তিযুদ্ধের দুর্গে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সব মানুষের যুদ্ধ, জনযুদ্ধ।

অবশ্য আমাদের মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতেই ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ তথা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। তিতুমীর, হাজি শরীয়তউল্লাহ, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, সুভাষ বসু, কাজী নজরুলের হাত ধরে সেই সংগ্রাম এগিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আসেনি। ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলা হয় পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে শৃঙ্খলিত। নতুন আঙ্গিকে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। 

১৯৫৪ সালে শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের মধ্য দিয়ে জনমন যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, ৯২-এর ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্য দিয়ে জনতার স্বপ্ন বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু জাতি পথ হারায় না। 
১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানি শাসকদের বিদায়ী সালাম জানানোর হুমকি দেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ছয় দফা পেশ করেন, যার মাঝে লুকায়িত ছিল স্বাধীনতার বীজ। শেখ মুজিব কারারুদ্ধ হন। তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা খ্যাত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় অভিযুক্ত করা হয়।

১৯৬৯ সালে ছয় দফাসংবলিত ১১ দফার ভিত্তিতে যে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, তাতে আওয়াজ ওঠে– ‘জেলের তালা ভাঙব/শেখ মুজিবকে আনব’। শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিরা মুক্ত হন। আগরতলা মামলা প্রত্যাহৃত হয়। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত হন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের ১৬০টি লাভ করে এবং পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে ছাত্র-জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছয় দফা এক দফায় পরিণত হয়। স্লোগান ওঠে– বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।

শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। বেসামরিক প্রশাসন তাঁর নির্দেশেই পরিচালিত হতে থাকে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পরিচালিত হতে থাকে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি। তরুণরা হয় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সবুজ জমিনে লাল বৃত্তের মাঝে সোনালি রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা সংগীতকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিসংগ্রামের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পল্টনের বিশাল সমাবেশে ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার ডাক দেন।

মার্চের মাঝামাঝি শুরু হয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরের আলোচনা শুরু হলে তা ভেস্তে যায়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বাঙালি সেনা, পুলিশ, ইপিআর, ছাত্র-জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা সমগ্র জাতি উদ্দীপ্ত হয়।

শেখ মুজিবকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর অবর্তমানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে ১০ এপ্রিল গঠিত হয় অস্থায়ী সরকার, যা মুজিবনগর সরকার বলে পরিচিত। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের এক আম্রকাননে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সরকারের কার্যক্রম শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। তাঁর অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে করা হয় প্রধান সেনাপতি। রণাঙ্গনের নেতৃত্বে ছিলেন শফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, আবু তাহের, খালেদ মোশাররফ, মঞ্জুর প্রমুখ সামরিক কর্মকর্তা।

মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী ভারত আমাদের পাশে ছিল। এক কোটি লোককে আশ্রয় দিয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল এবং চূড়ান্ত যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সমর্থন দিয়েছিল। পাশ্চাত্যের লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, জনগণ বাড়িয়েছিল সহযোগিতার হাত।

এ যুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিলেও ন্যাপ-ভাসানী, ন্যাপ-মোজাফফর, জাতীয় কংগ্রেসসহ বাম দলগুলো যোগ দিয়েছিল। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মণি সিংহ, অধ্যাপক মনোরঞ্জন ধর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। আলবদর, রাজাকার, শান্তি কমিটি ছাড়া সব মানুষই স্বাধীনতার সূর্যোদয়ে সারথি।
চব্বিশের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের আরাধ্য বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে উঠুক– এটাই সবার প্রত্যাশা।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×