জাতীয় নাগরিক কমিটির সংস্কার প্রস্তাব
গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি
.
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:০১ | আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:২৬
সংবিধান সংস্কার নয়, সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। তারা বলেছে, নতুন লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডারের অধীনে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। সংবিধান প্রণয়ন সম্পন্ন হলে এই গণপরিষদই আইনসভায় রূপ নেবে। সংসদ হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। উচ্চকক্ষ রাষ্ট্রপতির অধীনে এবং নিম্নকক্ষ প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকবে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে নাগরিক কমিটির দেওয়া প্রস্তাবনায় এসব দাবি জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে মতবিনিময় করে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এতে নাগরিক কমিটি ৬৯ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছে। তারা লিখিত প্রস্তাব পরে জমা দেবে বলে কমিশনকে জানিয়েছে।
নাগরিক কমিটির প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে– সরকারের মেয়াদ হবে চার বছর। কোনো ব্যক্তি দুইবারের বেশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না। বিরোধীদলীয় নেতাকে ছায়া-মন্ত্রিসভা গঠনের অধিকার দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
কোনো আদালতই প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণে রায় ঘোষণা করতে পারবেন না। কেবল সংসদ কর্তৃক আস্থাভোটই হবে তাঁকে অপসারণের বৈধ উপায়। সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যেন একক কর্তৃত্ব ভোগ না করেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সংসদ সদস্যরা শুধু আইন প্রণয়ন করবেন। স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা করবেন। সব স্থানীয় নির্বাচনে অনূর্ধ্ব ৩০ বছর বয়সীদের জন্য নতুন পদ সৃষ্টি করে তাদেরকে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
এতে বলা হয়, ৭০ অনুচ্ছেদের কঠোরতা খর্ব করতে হবে। সংসদ সদস্যরা দল বদল করলে তথা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে বা দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করলে বা অব্যাহতি দেওয়া হলে তাঁর সংসদ সদস্যপদ শূন্য হবে। আস্থা ভোটে দলের বিপরীতে ভোট দেওয়া যাবে না। অন্য যে কোনো বিষয়ে তিনি স্বাধীন থাকবেন; দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন।
নাগরিক কমিটি সংবিধানের পাঁচটি মূলনীতি প্রস্তাব করেছে। সেগুলো হলো– সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রকে প্রথম রিপাবলিকের এবং জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র জারি করে দ্বিতীয় রিপাবলিকের প্রস্তাবনা হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সংবিধানে প্রতিটি জাতিসত্তার স্বীকৃতি থাকতে হবে। দেশের নাগরিকরা ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচিত হবেন। তাদের প্রস্তাবনায় গণসার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির বিধান রাখার পাশাপাশি সংবিধানে গণভোটের বিধান রাখার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে সংবিধানের পরিবর্তনও শুধু গণভোটে করার প্রস্তাব রয়েছে।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উচ্চকক্ষের নাম হবে জাতীয় পরিষদ এবং নিম্নকক্ষের নাম হবে আইনসভা। ৩০০ আসনের আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হবেন জনগণের ভোটে। ১০০ সদস্যের জাতীয় পরিষদ হবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ৩৩টি আসনে পেশাজীবী-কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-আইনজীবী-চিকিৎসক-প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-সাংবাদিকসহ আইন দ্বারা তপশিলভুক্ত পেশা এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে মনোনয়ন দিতে হবে। আইন পাসে উভয় কক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে।
স্বাধীন বিচার বিভাগ গঠনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি। একইসঙ্গে প্রধান বিচারপতির অধীনে আলাদা সচিবালয় করার প্রস্তাব রয়েছে। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কথাও বলা হয়েছে।
নাগরিক কমিটি মনে করে, রাষ্ট্র সরকারের নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের বাইরে আনা গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আর প্রয়োজন হবে না। তবে আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মনে করে তারা। এ ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রশাসন নির্বাচনের আগের তিন মাস নির্বাচন কমিশনের অধীনে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে লড়াই জারি রাখার কথা বলেছি। মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নতুন বাংলাদেশ গঠন করব।’ সংবিধান কীভাবে পুনর্লিখন হবে– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আগের সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে বলে আমরা মনে করি। আমরা দীর্ঘ সময় ধরে নতুন সংবিধানের দাবি জানিয়ে আসছি। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংস্কারের কথা বলছে। তাদের সঙ্গে আমরা একমত নই।
গণপরিষদ কীভাবে হবে– এ প্রশ্নে আখতার হোসেন বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ হবে। গণপরিষদে যারাই নির্বাচিত হয়ে আসবেন, সংবিধান প্রণয়নের পরে তারাই আইনসভার সদস্য হিসেবে কাজ করবেন। এ ক্ষেত্রে নতুন করে সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজন থাকছে না।
মতবিনিময় সভায় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে আরও উপস্থিত ছিলেন মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, কেন্দ্রীয় সদস্য সারোয়ার তুষার, মুকুল মুস্তাফিজ, জহিরুল ইসলাম মুসা, আতিক মুজাহিদ ও সালেহ উদ্দিন সিফাত।
এদিকে সংবিধান পুনর্লিখনের প্রস্তাব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও দেওয়া হয়েছে বলে জানান সংগঠনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল। তিনি বলেন, আমরা পুনর্লিখনের কথা বলেছি। এ জন্য গণপরিষদ লাগবে। গণপরিষদ নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের লিখিত স্বীকৃতি থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করার জন্য রাষ্ট্রপতির হাতে কিছু ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব তারা দিয়েছেন বলে জানান আরিফ সোহেল।
মতবিনিময় সভায় সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ছিলেন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এ ছাড়া সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ফিরোজ আহমেদ, মুস্তাইন জহির, সুমাইয়া খায়ের, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকরামুল হক, মইন আলম ফিরোজি, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকী।
- বিষয় :
- জাতীয় নাগরিক কমিটি