সাক্ষাৎকারে জামায়াত আমির
নির্বাচন বিলম্বিত হলে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না সরকার
একাত্তরের জন্য গোলাম আযম ক্ষমা চেয়েছেন
ডা. শফিকুর রহমান
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহাম্মদ
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:০০ | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৬:৫৬
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, নির্বাচন বিলম্বিত হোক, তিনি তা চান না। এমনটি ঘটলে সরকার দেশের পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না। জামায়াত আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন চায়। একাত্তরের ভূমিকার জন্য সেই সময়ে সংগঠনের আমির গোলাম আযম ক্ষমা চেয়েছেন। আবার কেন ক্ষমা চাইতে হবে? জামায়াত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সব দলকে নির্বাচনে স্বাগত জানাবে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সরকারের বিষয়। ভারতের সঙ্গে সমতাপূর্ণ বন্ধুত্ব চায় জামায়াত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহাম্মদ
সমকাল: জামায়াত সংস্কার ও নির্বাচনের পৃথক রোডম্যাপ চেয়েছিল। জামায়াতের গুরুত্ব কীসে? সংস্কারে, না নির্বাচনে?
শফিকুর রহমান: দেশের মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করছে। যুক্তিসংগতভাবে বোঝা যাবে, আগে সংস্কার হবে, পরে নির্বাচন। তবে সংস্কার পর্যন্ত নির্বাচনের সব কার্যক্রম স্থগিত রাখার প্রয়োজন নেই। সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় লাগবে। সরকারের মেয়াদকাল দীর্ঘায়িত হলে জাতির জন্য কল্যাণ নেই। আবার সংক্ষিপ্ত হলে প্রয়োজনীয় সংস্কার হবে না।
সমকাল: সংস্কারের আগেই নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেল! আওয়ামী লীগ আমলে ক্ষমতাসীনদের পছন্দে কমিশন গঠন হতো, এবারও তাই হলো। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নাম বিএনপি এবং জামায়াতের তালিকায় ছিল।
শফিকুর রহমান: আপনারা (সাংবাদিক) কীভাবে জানলেন, কার নাম দিয়েছি? এটা তো রাষ্ট্রীয় আমানত।
সমকাল: নির্বাচন কমিশনাররা যে দলের পছন্দে এসেছেন, তাদের প্রতি পক্ষপাত করবেন না?
শফিকুর রহমান: উপদেষ্টা পরিষদও তো সবার মতামত নিয়ে হয়েছে। সবাই কি নিজের লোক দেয়? চিন্তা করে দেয়– কার হাতে পতাকার মর্যাদা রক্ষিত হবে।
সমকাল: বিএনপি বলছে, সব সংস্কার এই সরকারের করার দরকার নেই।
শফিকুর রহমান: আমরাও তাই বলছি। জামায়াতের ৪১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের মাত্র ১০টি এই সরকারকে করতে বলেছি। বাকিগুলো নির্বাচিত সরকার করবে।
সমকাল: আওয়ামী লীগ প্রশ্নে একেক দলের অবস্থান একেক রকম। বিএনপি জনগণের ওপর ছেড়ে দিতে চায়। ড. ইউনূস স্পষ্ট করে বলেছেন, বিচারের পর আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে স্বাগত জানানো হবে। জামায়াত কী চায়?
শফিকুর রহমান: আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে, নির্বাচনে বিশ্বাসী নয়। সেই আওয়ামী লীগকে ডেকে আনার দায়িত্ব কে নেবে? কেন নেবে? আগে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করুক– তারা গণতান্ত্রিক দল। প্রমাণ করতে পারলে জনগণ বিবেচনায় নেবে।
সমকাল: এটা প্রমাণের পথ আছে?
শফিকুর রহমান: অবশ্যই আছে। উনি (শেখ হাসিনা) বিদেশে পালালেন কেন? রাজনীতিবিদরা নয়; পালায় অপরাধীরা।
সমকাল: আপনার বক্তব্যে স্পষ্ট– নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে চান না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে?
শফিকুর রহমান: গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সব দলকে নির্বাচনে স্বাগত জানাব। জামায়াতকে কত কিছু করা হয়েছে। নিবন্ধন কেড়ে নেওয়ার পরও নির্বাচনে অংশ নিয়েছি অন্যের প্রতীকে। সরে যাইনি।
সমকাল: আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে জামায়াতের অবস্থান কী? জামায়াত নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ হয়েছিল। আওয়ামী লীগের একই পরিণতি নিশ্চয় চান না।
শফিকুর রহমান: নিষিদ্ধ কেউ যদি নিজেকে করে, কী করব? আওয়ামী লীগ নিজেকে নিষিদ্ধ করেছিল। জনগণের মনোভাব বুঝে, সরকার যেটা ভালো মনে করে করবে।
সমকাল: জামায়াতের এই অবস্থান বিএনপির বিপরীতে।
শফিকুর রহমান: চব্বিশের অভ্যুত্থান, গণহত্যাকে কেউ কি অস্বীকার করবে? স্বজনদের কান্না কি বন্ধ হয়েছে? আহতরা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে? এই যে ট্রমা; তারা কী চায়– জাতিকে বুঝতে হবে। তাদের আত্মত্যাগেই জাতি স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। জাতীয় বীরদের চাওয়াকে কি অস্বীকার করব?
সমকাল: গত ১৫ বছরের অপকর্ম ও গণহত্যার জন্য পুরো আওয়ামী লীগ, নাকি শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার দায়ী? আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মী নিশ্চয় দায়ী নয়।
শফিকুর রহমান: যারা দৃশ্যমান ছিল, তারা কোনো না কোনো অপরাধ করেছে। গ্রামগঞ্জে বাবা-ছেলে একসঙ্গে ভাত খেতে পারেনি। সেখানে কে পুলিশ নিয়ে গেছে? কর্মীরাই নিয়ে গেছে।
সমকাল: এ তুলনায় গণহত্যার অপরাধ হালকা হয়ে যায়।
শফিকুর রহমান: সব অপরাধীকে শাস্তি পেতে হবে। নইলে অপরাধ চলতে থাকবে। এখনও অপরাধ বন্ধ হয়নি।
সমকাল: একাত্তরে জামায়াত পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। আপনার ভাষ্যমতে, জুলাই গণহত্যার জন্য পুরো আওয়ামী লীগ দায়ী। তাহলে একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার জন্য জামায়াতও দায়ী।
শফিকুর রহমান: … কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। ভুল এক জিনিস, অপরাধ আরেক জিনিস। ধরুন, একজন অসহায় বন্দুকের নলের মুখে..। এখনও তো হয়েছে। সমন্বয়কদের ধরে নিয়ে কী করা হলো? এটা চিরদিন ছিল।
একাত্তরে গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলার পরিবেশ ছিল? তখন সামরিক শাসন ছিল। জামায়াত বলেনি; অমুক দল বলতে পেরেছে– এমন কোনো নজির আছে? ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা হলেও স্বাধীনতা বাস্তবে অর্জিত হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর। এর পরও কথা আছে। জামায়াত কি ফেরেশতার দল? কিন্তু ঘাড়ে ধরে চাপ দিয়ে ভুল স্বীকার করা, এর জন্য ক্ষমা চাওয়া– এটা তো হতে পারে না।
সমকাল: ভুল না থাকলে গোলাম আযম কীসের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন?
শফিকুর রহমান: ১৯৯২ সালে গোলাম আযম পরিষ্কারভাবে ক্ষমা চেয়েছেন। উনি একাত্তরে জামায়াতের আমির ছিলেন। আমি কে ক্ষমা চাওয়ার? তিনিই সঠিক এবং রেসপনসিবল ব্যক্তি ছিলেন। উনার ক্ষমা চাওয়া জাতি যদি কবুল করে নেয়, আলহামদুলিল্লাহ।
সমকাল: জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করায় যদি অপরাধী হয়, তাহলে মালেক মন্ত্রিসভার শরিক জামায়াত কেন অপরাধী নয়?
শফিকুর রহমান: মানুষ জাতীয় পার্টিকে অপরাধী মনে করে গণহত্যাকারীর সঙ্গে থাকায়। তারা গণহত্যা করেছে– এই কথা কেউ বলছে না। একাত্তরে জামায়াতের দুই মন্ত্রীর দ্বারা একাত্তরে যদি জুলুম হয়ে থাকে; সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে জামায়াতের ক্ষমা চাইতে অসুবিধা নেই।
সমকাল: শেখ হাসিনার পুরো মন্ত্রিসভাকে যেভাবে দায়ী করছেন, তাহলে মালেক মন্ত্রিসভার জামায়াতের মন্ত্রীরা কেন দায়ী নন?
শফিকুর রহমান: হ্যাঁ, এই মাইনর রেসপন্সিবিলিটি তো নিতে হবে।
সমকাল: আপনার ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বলে জানিয়েছিলেন।
শফিকুর রহমান: মুক্তিযুদ্ধ ছিল আপামর জনতার। নিজেকে শহীদ পরিবারের সদস্য বলে মুক্তিযুদ্ধকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করতে চাই না।
সমকাল: বিএনপির সঙ্গে ২৩ বছর জোটে ছিলেন। এখন আপনারা প্রতিযোগী, প্রতিদ্বন্দ্বী, না সহযোগী?
শফিকুর রহমান: সহযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিরোধিতা নিয়েই রাজনীতি। জোট না থাকলেও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। তাদের কর্মসূচিতে আমরা যাই, তারাও আসেন।
সমকাল: আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন থাকায় আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে কাদের মধ্যে? আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মতো হয়ে যাবে না তো?
শফিকুর রহমান: আওয়ামী লীগ তো জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব ঠিক করে দিত। এ রকম আর দেখতে চাই না।
সমকাল: বর্তমান সরকারের সমর্থন জামায়াত পাচ্ছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
শফিকুর রহমান: সরকারের কেউ জামায়াতের কর্মী. রুকন নন। সরকারে আমাদের কেউ নেই। এগুলো জামায়াত এবং সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার।
সমকাল: আরেকটি গুঞ্জন হলো, ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে জামায়াত নির্বাচন বিলম্বিত চায়।
শফিকুর রহমান: তা চায় না। নির্বাচন বেশি বিলম্বিত হলে সরকার দেশের পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না। মৌলিক সংস্কার করে নির্বাচন দেওয়া উচিত।
সমকাল: সরকারের চার মাসের কাজকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শফিকুর রহমান: সাড়ে ১৫ বছরের আবর্জনা দূর করতে সময় লাগবে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে সরকার টেনে তোলার চেষ্টা করছে। আইনশৃঙ্খলার কী পরিস্থিতি ছিল? ওবায়দুল কাদের বলেননি– আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়লে পাঁচ লাখ মানুষ মরবে। কিছুই তো হয়নি।
সমকাল: কিছুই হয়নি বলা ঠিক হবে না। আওয়ামী লীগের ৭০-৭৫ জন নিহত হয়েছে।
শফিকুর রহমান: একটি মৃত্যুও কাম্য নয়। এখন কী হচ্ছে? এই দাবি, ওই দাবি। কে ওদের পাঠাচ্ছে? এই পাড়ের উস্কানি আর ওই পাড়ের টেলিফোন। এগুলো না হলে দেশ আরও ভালো চলত।
সমকাল: তাহলে সরকারকে দায়মুক্তি দিচ্ছেন?
শফিকুর রহমান: প্রশ্নই আসে না।
সমকাল: বিশৃঙ্খলার কারণে জুলাই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হতে পারে?
শফিকুর রহমান: মূল বিষয়ে মানুষের ঐক্য থাকলে ব্যর্থ হবে না।
সমকাল: ২০১০ সালে জামায়াত মানবতাবিরোধী আইনকে কালো আইন বলত। সেই আইনে শেখ হাসিনার বিচার হচ্ছে। একে সমর্থন করেন?
শফিকুর রহমান: আইন সংস্কার হচ্ছে। আইন ছিল জুলুমের। বিচারকরা এর চেয়েও জুলুম করেছেন।
সমকাল: সেই একই জিনিস শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে হলে অবিচার হবে না?
শফিকুর রহমান: শুধু আদালতে নয়; সমাজেও বিচার পাইনি। আইন সংশোধন এবং বিচারেও স্বাধীনতা থাকা উচিত।
সমকাল: এক সময় জামায়াত বলত– ‘আল্লাহর আইন চাই’। এখন বলছে– ‘কল্যাণ রাষ্ট্র চাই’।
শফিকুর রহমান: ইসলাম তো কল্যাণেরই বিধান দিয়েছে। এটা মৌলিক পরিবর্তন নয়।
সমকাল: নারী অধিকার, নারীদের অবাধে কাজের সুযোগ নিয়ে কথা বলছেন। স্থানীয় সরকারে জামায়াত নারী প্রার্থী দেয়; সংসদে দেয় না কেন?
শফিকুর রহমান: যোগ্য প্রার্থী পেলে চিন্তা করব, কী করা যায়। এই দেশ সব লিঙ্গের এবং সব ধর্মের মানুষের। যে ধর্মে বিশ্বাস করে না, তারও। ধর্ম কবুল না করায় কাউকে কখনও শাস্তি দেওয়া হয়নি। অধিকারে কমতি হবে না। জামায়াত চায়, নারীরা মর্যাদা এবং নিরাপত্তার সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজে অবদান রাখবে।
সমকাল: আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে বড় পার্থক্য জামায়াতের। আনুপাতিক হলে সবচেয়ে সুবিধা পাবে আওয়ামী লীগ।
শফিকুর রহমান: আওয়ামী লীগের চিন্তায় তো রাষ্ট্রের সংস্কার হবে না। বিএনপি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্যমান পদ্ধতি চায়, তা তারা বলবে। আমরা চাই প্রতিটি ভোটের মূল্য থাকুক। দশমিক ৩৩ শতাংশ ভোট যে দল পাবে, তারাও একটি আসন পাবে।
সমকাল: শোনা যাচ্ছে, জামায়াত আগামী নির্বাচনে দলের বাইরে থেকে প্রার্থী করতে পারে।
শফিকুর রহমান: দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে করবে ইনশাআল্লাহ।
সমকাল: ভারত থেকে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার চলছে। আপনি বলেছেন, ‘জামায়াত ভারতবিরোধী নয়’। সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক– এই বিষয়ে জামায়াতের অবস্থান কী?
শফিকুর রহমান: সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘুতে বিশ্বাস করি না। এ দেশে সবাই সমান নাগরিক। সমান অধিকার থাকবে। সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু মানেই হিংসা। ভারতীয় অপপ্রচারের জবাব সবাই দিচ্ছে। ভারতীয় মিডিয়াও দিচ্ছে। উস্কানি কারও জন্য ভালো নয়। ভারতের দুশমন হবো কেন? ভারতে বিভিন্ন ধর্মের লোক বাস করে না? ভারতের সরকারগুলো সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের প্রমাণ দিতে পারেনি। আমরা সম্মান ও সমতাপূর্ণ বন্ধুত্ব চাই।