ঢাকা রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

সাবেক তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

১১৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ

সাবেক তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

বাঁ দিক থেকে- জাহিদ মালেক, জুনাইদ আহমেদ পলক ও মির্জা আজম

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৬:৩১ | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০২

ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আওয়ামী লীগের সাবেক তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বৃহস্পতিবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ের তিন অনুসন্ধান কর্মকর্তা তাদের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে কমিশনের ঢাকা-১ কার্যালয়ে মামলাগুলো করেন। 

তারা হলেন– সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক; সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম। তাদের বিরুদ্ধে প্রায় ১১৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের নামে ব্যাংকে শত শত কোটি টাকার লেনদেনের হিসাব পাওয়া গেছে। 

অন্য তিন আসামি হলেন– জাহিদ মালেকের ছেলে রাহাত মালেক, মির্জা আজমের স্ত্রী দেওয়ান আলেয়া ও পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন।  

আজ দুদকের প্রধান কার্যালয়ের মহাপরিচালক ও মুখপাত্র আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মামলাগুলো করা হয়েছে। 

দুদকের নতুন চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনসহ কমিশনের এক সদস্য বুধবার যোগ দেওয়ার পরদিন বৃহস্পতিবার সাবেক তিন মন্ত্রীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেন। এদিনই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। একই দিনে সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা, সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধের জন্য আদালতে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শিগগির আবেদনগুলো ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজের কাছে জমা দেওয়া হবে। 

জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর আগের কমিশন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপিসহ প্রভাবশালী প্রায় ২০০ জনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতি, দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের অনুমোদন দিয়েছে। অভিযোগগুলোর অনুসন্ধান করা হচ্ছে। অভিযোগের মধ্য থেকে বৃহস্পতিবার সাবেক তিন মন্ত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এর আগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। শিগগির আরও প্রভাবশালী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। 

এজাহারে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ৬১ কোটি ৪২ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তা ভোগদখলে রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে নিজের ও প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৪টি হিসাবের মাধ্যমে পরস্পর যোগসাজশে ১৪৩ কোটি ১০ লাখ টাকা জমা এবং ১১৫ কোটি ৮৫ টাকা উত্তোলন করে হস্তান্তর, রূপান্তর, স্থানান্তরের মাধ্যমে সন্দেহজনক অসংখ্য লেনদেন করেছেন, যা মানি লন্ডারিং অপরাধ। 

জাহিদ মালেকের ছেলে আসামি রাহাত মালেকের বিরুদ্ধে তাঁর বাবা স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ১১ কোটি ৪৯ লাখ ৮৪ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। তিনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতিষ্ঠান ও নিজের নামে ব্যাংক হিসাবে ৬৬৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা জমা করেন এবং ৬৬৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। এ ক্ষেত্রে অসংখ্য সন্দেহজনক লেনদেন রয়েছে।

জাহিদ মালেকের স্ত্রী শাবানা মালেকের নামে জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত ৩ কোটি ১১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়া গেছে। তাঁর নামে-বেনামে আরও সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। রাহাত মালেকের স্ত্রী সাকিবা মালেকের নামে ৯ কোটি ২৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। জাহিদ মালেকের মেয়ে সাদিয়া মালেকের নামে ১ কোটি ৮৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। আরেক মেয়ে সিনথিয়া আকমলের নামেও ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পদ পাওয়া গেছে।

এজাহারে সাবেক মন্ত্রী পলকের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ৯ কোটি ৫৮ লাখ ৯৩ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। নিজের নামে ৩১টি ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনকভাবে ২২ কোটি ৩৪ লাখ ৭১ হাজার টাকা জমা এবং ১৭ কোটি ৫৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অস্বাভাবিক লেনদেন করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে পলকের স্ত্রী আসামি আরিফা জেসমিনের নামে জমি, প্লট এবং ফ্ল্যাট ক্রয় ও দোকানসহ ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ এবং উপহার হিসেবে প্রাপ্ত সম্পদ ব্যতীত, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র, ডিপিএস, হাতে নগদ ও বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিতসহ মোট ৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদসহ ৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা মূল্যের সম্পদ পাওয়া যায়। আরিফা জেসমিনের আয়কর নথিতে পারিবারিক ব্যয় পাওয়া যায় ১ কোটি ২৬ লাখ ৭১ হাজার টাকা। তাঁর নামে মোট ১০ কোটি ৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকার সম্পদ পাওয়া যায়। স্বামী পলক ঘুষ ও দুর্নীতির অর্জিত অর্থ দিয়ে স্ত্রীর নামে সম্পদ করেছেন।

মির্জা আজম প্রতিমন্ত্রী ও এমপির দায়িত্বে থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রভাব খাটিয়ে তাঁর নিজ নামে-বেনামে ও তাঁর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোম্পানি-প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ ৬৭ টাকা অর্জন করেছেন। মেয়ে মির্জা আফিয়া আজম অপির নামে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৮৩ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া গেছে। পিতা কর্তৃক অর্জিত অবৈধ সম্পদ তাঁর নামে রাখা হয়েছে। মির্জা আজমের অপরাধলব্ধ ২০ কোটি ৭৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পত্তি পরিবারের সদস্যসহ অন্যদের নামে হস্তান্তর ও রূপান্তর করেছেন।

তাঁর স্ত্রী আসামি দেওয়ান আলেয়ার নামে তাঁর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানির নামে ৬০টি ব্যাংক হিসাবে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৭২৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা জমা এবং ৭২৪ কোটি ৮৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। অস্বাভাবিক লেনদেনের মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তর করে মানি লন্ডারিং আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।

এ ছাড়া বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত হয়েছে সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম, নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন, আবু জাহির, এইচ এম ইব্রাহিম, নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন, একই সঙ্গে তাদের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে; সাবেক রেলমন্ত্রী মজিবুল হক, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও তাঁর স্ত্রী-সন্তান; বাহাউদ্দিন বাহার ও তাঁর মেয়ে তাসনিম বাহার সূচনা; আমির হোসেন আমু ও তাঁর পালিত কন্যা সুমাইয়া, ফররুখ মজিদ মাহমুদ কিরণ ও তাঁর স্ত্রী রাফেজা মজিদের বিরুদ্ধে।

বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার সময় বৃদ্ধির আবেদন করা হবে সমবায় ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহি, শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, স্ত্রী মহমিনা আক্তার, লিয়াকত আলী লাকিসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে, যাদের নামে এরই মধ্যে মামলা হয়েছে।

এছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস মনির হোসেন ও তাঁর স্ত্রী, সাবেক এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন, সাবেক মন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান ও আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ ও স্থাবর সম্পদ ক্রোক করা হবে।

 

আরও পড়ুন

×