ঢাকা সোমবার, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫

হতদরিদ্ররা কাঁপছে ঠান্ডায়, শীত ব্যবস্থাপনা ঠনঠন

সরকার এবারও কিনতে পারেনি কম্বল

হতদরিদ্ররা কাঁপছে ঠান্ডায়, শীত ব্যবস্থাপনা ঠনঠন

কনকনে ঠান্ডা আর হিমেল বাতাসে বিপর্যস্ত কুড়িগ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষ। গরম কাপড়ের অভাবে পুরোনো লুঙ্গি গায়ে জড়িয়ে কাজে বেরিয়েছেন একজন শ্রমজীবী। জেলা শহরের ধরলা সেতু এলাকা থেকে তোলা- সুজন মোহন্ত

 জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:২৩ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১০:৫০

পৌষের আগেই শীতের দাপট। হতদরিদ্র শীতার্ত মানুষ ঠকঠকিয়ে কাঁপলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এখনও কিনতে পারেনি ত্রাণের কম্বল। গেল বছর কম্বল নিয়ে একই বিপত্তিতে পড়েছিল সরকার। এবার নভেম্বরে দরপত্র আহ্বান করার পরও কম্বল কিনতে না পেরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে নগদ টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। সেই টাকায় স্থানীয় বাজার থেকে মানহীন কম্বল শীতার্ত মানুষকে গছানোর অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা কিছু কম্বল বিতরণ করে নিজেদের দায়িত্ব সারতে চাইছেন। এ সময়ে এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি না থাকায় শীতার্তদের তালিকা তৈরি ও বিতরণেও লেগেছে ভজকট।

অন্যদিকে, বেসরকারি পর্যায়ে শীতবস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়ার রেওয়াজ থাকলেও এবার সামাজিক, রাজনৈতিক, মানবিক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের তরফ থেকে বড় পরিসরে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক উত্তাপে শীতে বিপর্যস্ত মানুষের কষ্ট গণমাধ্যমে উঠে আসছে না। এ ছাড়া গত বন্যায় মানবিক উদ্যোগ নানা বিতর্কের মুখে পড়ে। ফলে এখন আর খুব বেশি মানুষ মানবিক উদ্যোগে যুক্ত হতে চান না। 

এদিকে রাজধানী ঢাকায় ছিন্নমূল মানুষকে শীত থেকে বাঁচাতে এবার কোনো উদ্যোগ নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র ও কমিশনার না থাকায় শীতবস্ত্র বিতরণে কোনো তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে না।

প্রতিবছরই শীত মৌসুমে ঠান্ডাপ্রবণ এলাকায় মানুষের কাজের সুযোগ কম থাকে। তবে এবারের শীতে দিনমজুরি কাজের পরিধি অন্য সময়ের চেয়ে কমেছে। এ পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য দরকার মানবিক সহয়তা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঝড়-বৃষ্টি কিংবা বন্যা ঘিরে সরকারের বড় প্রস্তুতি থাকলেও শীতে তা দেখা যায় না। কারণ, শীতকে সরকারিভাবে এখনও ‘দুর্যোগ’ ঘোষণা করা হয়নি। শীত ঘিরে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পনা, বাজেট প্রণয়ন কিংবা কোনো নীতিমালাও নেই। ফলে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও হাত গুটিয়ে বসে থাকে।

সব মিলিয়ে শীত মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগে দীর্ঘদিনের যে সমন্বয়হীনতার বৃত্ত, তা থেকে বের হতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকারও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শৈত্যপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় নীতি ও পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। শুধু শীতবস্ত্রের মধ্যে সহায়তা সীমাবদ্ধ না রেখে শৈত্যপ্রবাহে বিপর্যস্ত মানুষের খাদ্য সহায়তাসহ নানা প্রণোদনার ব্যবস্থা করা উচিত। 

এ মৌসুমে তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামতে পারে বলে আগেই জানিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে ১২টি শৈত্যপ্রবাহ ও শিলাবৃষ্টি হতে পারে। ইতোমধ্যে তাপমাত্রা ১০-এর ঘরে চলে এসেছে। এ অবস্থায় শীত মোকাবিলায় প্রস্তুতির ঘাটতি আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। 

এখনও কম্বলের খবর নেই

ত্রাণের কম্বল কেনার জন্য গত ৯ নভেম্বর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর দরপত্র আহ্বান করে। এক মাসেও দরপত্রের সেই কম্বল আসেনি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বলছে, দরপত্রের পর অনেক প্রক্রিয়া শেষ করেই কম্বল সরবরাহ করা হয়। অল্প কিছু দিনের মধ্যে কম্বল পাওয়া যাবে। তবে এরই মধ্যে শীত বেড়ে যাওয়ায় জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের অনুকূলে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, নিম্নমানের কম্বলের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকার দরপত্রে অনেক শর্ত দিয়েছে। কম্বলের গুণগত মান নির্ধারণ করে স্পেসিফিকেশন ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। কম্বলের দৈর্ঘ্য ৮ ফুট এবং প্রস্থ ৬ ফুট। ডাবল পার্ট, বোথসাইড ব্রাশ, অ্যান্টি পাইলিং, ওজন ২৫০০ গ্রাম এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। এই শর্ত মেনে যারা কম্বল সরবরাহ করবে, শুধু তারাই যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। ফলে শর্তের মারপ্যাঁচে পড়ে কেনাকাটা জটিল হয়ে পড়ে। এতে প্রতি বছর কম্বল কিনতে দেরি হচ্ছে। 

মানবিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন নির্দেশিকা অনুযায়ী, ত্রাণের কম্বল কেনার কাজ বাস্তবায়ন করবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান সমকালকে বলেন, যে দরপত্র দেওয়া হয়েছে, সেই কম্বল দ্রুত চলে আসবে। তবে এরই মধ্যে শীত পড়তে শুরু করায় আমরা বসে নেই। শীতপ্রবণ প্রতিটি জেলা-উপজেলায় কম্বল কেনার জন্য জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তারা স্থানীয় বাজার থেকে কম্বল কিনে বিতরণও করেছেন। পাশাপাশি মজুত থাকা আগের কম্বলও শীতার্তদের দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২৯ জেলায় প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিল থেকে ২ লাখ ৯০ পিস কম্বল পাঠানো হবে। স্থানীয় প্রশাসনের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত কম্বলের ব্যবস্থা আছে। খাদ্য সহায়তার চাহিদা এলে সেই ব্যবস্থাও করা হবে। 

তবে প্রতি বছর অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে কম্বল কিংবা অর্থ বরাদ্দে তথ্য থাকলেও এবার তা নেই। এদিকে মহাপরিচালকের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল কম। গতকাল বৃহস্পতিবার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে শীতবস্ত্রের জন্য হাহাকার দেখা গেছে।

ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচ উপজেলার মধ্যে চারটি ভারতের সীমানাঘেঁষা। একদিকে সীমান্ত, অন্যদিকে হিমালয়ের হিম বাতাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। প্রায় ১৫ লাখ মানুষের শীতপ্রবণ এ জনপদে শীতবস্ত্র বরাদ্দ অনেকটাই কম। সদর উপজেলার নারগুন ইউনিয়নের শ্রমিক লতিফুর রহমান বলেন, ‘প্রতিবারে কম্বল ঠান্ডার শেষে দেওয়া হয়। গতবার পাইনি, এবারও কম্বল মিলবে কিনা, জানি না।’

নীলফামারীর ত্রাণ ও দুর্যোগ দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম ধাপে ২৫ হাজার কম্বলের চাহিদা পাঠানো হয়েছিল। পাওয়া গেছে মাত্র ১ হাজার ২০০টি। এখানে ছয় উপজেলার প্রতিটিতে ২০০টি করে দেওয়া হয়েছে, যা বিতরণ হয়নি এখনও। এ ছাড়া ১৮ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এ টাকা উপজেলা প্রশাসন কম্বল কিনে বিতরণ করবে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান জানান, ইতোমধ্যে ১ হাজার ২০০ কম্বল ও ১৮ লাখ টাকা পেয়েছি। শিগগিরই সেগুলো বিতরণ করা হবে। 

পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন জানায়, শীতের শুরুর দিকে দুই হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সেই টাকা দিয়ে দু-এক দিনের মধ্যে কম্বল কিনে বিভিন্ন উপজেলায় বিতরণ করা হবে। পঞ্চগড় পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আজাহারুল ইসলাম জুয়েল বলেন, জেলায় প্রায় দুই লাখের মতো দুস্থ মানুষ বাস করে। এ বছর এখনও সেভাবে কম্বল বিতরণ দেখা যায়নি। 

কুড়িগ্রামে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে বিতরণ করা হয়নি কম্বল। জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত ৯ উপজেলার ২৩ লাখ ২৯ হাজার ১৬১ জন মানুষের বিপরীতে ১ হাজার ৮০০টি কম্বল বরাদ্দ রয়েছে, যা প্রতি উপজেলায় ২০০টি করে বিতরণ করা হবে। রৌমারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শামসুদ্দিন বলেন, এ উপজেলায় ২০০ কম্বল বরাদ্দ হয়েছে। রাজীবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, ২০০ কম্বল বরাদ্দ পেয়েছি। তবে এখনও উপজেলায় আনা হয়নি। উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, এখনও সরকারি বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। পেলেই বিতরণ শুরু হবে। ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম ফেরদৌস বলেন, আমার উপজেলার জন্য ২০০ কম্বল পেয়েছি। এখনও বিতরণ করিনি।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বিলপাড়া গ্রামের হালিমা বেওয়া বলেন, ‘সরকারি কম্বল গ্রামে আসে না। কম্বলের জন্য ডিসি অফিসে গেলে হয়তো পাব, কিন্তু দুইশ থেকে আড়াইশ টাকার কম্বল নিতে আরও দুইশ টাকা ভাড়ায় চলে যাবে। সে জন্য কম্বলের পেছনে না ছুটে কষ্টে দিন পার করছি।’ জেলা প্রশাসক ইসরাত ফারজানা বলেন, বিশেষ বরাদ্দের ১ হাজারটি কম্বল পেয়েছি, যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। 

মানহীন কম্বলে শীত মানছে না

শীতে বিপর্যস্ত গরিবের কাছে কম্বল যেন অমূল্য রতন। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের জেলা পর্যায়ে পাঠানো টাকায় যে কম্বল কেনা হয়েছে তাতে শীত মানছে না। এসব কম্বলে শীত নিবারণের মূল উপাদান উলের অস্তিত্বই নেই। কুড়িগ্রামের বাসিন্দা নুর হোসেন বলেন, ‘দুই পাটের (স্তর) হলে ভালো হতো। কম্বল খুবই পাতলা, আর আকারও অনেক ছোট। একজনের বেশি থাকা যায় না।’ 

ঠাকুরগাঁওয়ের আবদুর রহমান বলেন, ‘শীতে সরকারিভাবে যে কম্বল দেওয়া হয়, তা খুবই নিম্নমানের। গত বছর ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকায় যে কম্বল বিক্রি হয়েছে, তা সরকারি কম্বলের চেয়ে অনেক ভালো।’

শীতকে দুর্যোগ ঘোষণা কতদূর

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বর্তমানে শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষ ভয়ানক কষ্টে আছে। শীতে মানুষ কষ্ট পাবে আর কেউ কেউ শহরে বসে লেপ-কম্বল-জ্যাকেট-সোয়েটার মুড়ে শীত উপভোগ করবে, সেটা অমানবিক। কনকনে শীতে দেশের যেসব জেলার মানুষ কাঁপছে তাদের জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করা সবচেয়ে জরুরি কাজ। এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি অবস্থাসম্পন্ন মানুষ ও সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। শীতার্ত মানুষকে বাঁচাতে শৈত্যপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করা উচিত। তাহলে সে অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা নেওয়া সহজ হবে। 

এ ব্যাপারে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মমিনুল ইসলাম বলেন, শীত কিংবা শৈত্যপ্রবাহকে ‘দুর্যোগ’ ধরা না হলেও আমরা নিয়মিত আগাম তথ্য দিয়ে মানুষকে সতর্ক করছি। যখন কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা ১ হাজার মিটারের নিচে নেমে আসে, কুয়াশার তীব্রতা বেশি থাকে, তখন সাধারণত আমরা ‘ফগ অ্যালার্ট’ জারি করি। এ ধরনের সতর্কবার্তার মাধ্যমে মূলত যানবাহন চলাচলে বিশেষ সতর্কতা নিতে বলা হয়। তিনি বলেন, আমরা বারবার সতর্ক করলেও শীত মোকাবিলার মতো প্রস্তুতি দেশের মানুষের থাকে না। এ কারণেই মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

এ ব্যাপারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন আছে। শৈত্যপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করতে হলে অনেক প্রক্রিয়া মানতে হয়। তবে আমরা এ বিষয়ে সুপারিশ করব।

আরও পড়ুন

×