নদীর পলি নদীতেই কাজ হচ্ছে না খননে
যমুনা নদীতে সারা বছর ড্রেজার মেশিন চললেও ঠিকমতো খনন হয় না। নাব্য সংকটের সমাধানও হয় না। শিবালয় ঘাট এলাকা সমকাল
আজু শিকদার, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) ও নিরঞ্জন সূত্রধর, শিবালয় (মানিকগঞ্জ)
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৫৮
‘সারা বছর দেখি নদীতে ড্রেজার মেশিন বসানো। কিন্তু ঠিকমতো ড্রেজিং (খনন) করা হয় না। যেটুকু করা হয়, সেই পলিমাটি ফেলা হয় নদীতেই। এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ড্রেজিংয়ের নামে প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। নাব্য সংকট তো কাটছেই না; নৌ চলাচলে প্রতিনিয়ত বিঘ্ন ঘটছে।’
ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকার ব্যবসায়ী ইনতাজ উদ্দিন। তাঁর মতো ক্ষোভ অনেকেরই। কারণ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ও আরিচা-কাজীরহাট নৌপথে নাব্য সংকট যেন স্থায়ী হয়ে গেছে। বছরজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ এ দুই নৌপথে বিভিন্ন স্থানে খনন চললেও সমাধান মিলছে না। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম প্রবেশদ্বার রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী, যানবাহন পদ্মা ও যমুনা নদী পার হয়ে গন্তব্যে যায়। যদিও পদ্মা সেতু হওয়ার পর কিছুটা চাপ কমেছে। কিন্তু নাব্য সংকটের কারণে এই পথে ভোগান্তি যায়নি। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই এ সংকট তীব্র হয়েছে। এদিকে মানিকগঞ্জের আরিচা থেকে পাবনার কাজীরহাট নৌপথেও নাব্য সংকট তীব্র। রাত-দিন ড্রেজিং করেও সমাধান মিলছে না। ফলে কয়েক দিন পরপর বন্ধ থাকছে ফেরি চলাচল। বেড়েছে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ভোগান্তি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ড্রেজার মেশিন দিয়ে খনন করা পলি নদীতেই ফেলা হয়। আবার চ্যানেলের কিছু পলি অপসারণ করে রাখা হয় চরে। বর্ষাকালে স্রোতে ভেসে সে পলি খনন করা চ্যানেলে ভরে যাচ্ছে। এতে খননের সুফল মিলছে না।
জানা গেছে, আরিচা-কাজীরহাট নৌপথে নাব্য সংকটের কারণে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ড্রেজিং ইউনিট গত ২৮ জুলাই থেকে পলি অপসারণের কাজ করছে। সংস্থাটি নিজস্ব আটটি ড্রেজার দিয়ে কাজ শুরু করলেও ফেরি চলাচল স্বাভাবিক করতে পারেনি। ১ নভেম্বর শুরু করে তিন দফায় ১০-১২ দিন ফেরি চলাচল বন্ধ রাখতে হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর আরিচা-কাজীরহাট, নগরবাড়ী ও বাঘাবাড়ী নৌপথে ছয় কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে তিন লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণ করা হয়। এ বছর আরিচা-কাজীরহাট-নগরবাড়ী, মুন্সিখোলা, কৈটোলা-মোহনগঞ্জ-বাঘাবাড়ী নৌপথে তিন কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩৮ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণ করা হবে। এ বছর দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে কত পলি অপসারণ করা হবে, তা এখনও নির্ধারণ হয়নি। জরিপ চলমান। গত ২৮ জুলাই থেকে আরিচা-কাজীরহাটে ৭টি ড্রেজার, মোল্লারচরে ১টি, নগরবাড়ীতে ১টি, মুন্সীখোলায় ১টি, কৈটোলায় ১টি, মোহনগঞ্জে ১টি ও গত ২৩ অক্টোবর দৌলতদিয়া ৭ নম্বর ফেরিঘাটের কাছে ২টি ড্রেজার দিয়ে পলি অপসারণ করা হচ্ছে।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে দৌলতদিয়ার ৭ নম্বর ফেরিঘাটে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। একই অবস্থা পাটুরিয়ার ৩ নম্বর ঘাটেরও। নাব্য সংকটের কারণে দৌলতদিয়া ৭ নম্বর ঘাটের বিপরীত পাশে আটকা পড়েছে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীগামী পণ্যবাহী কয়েকটি কার্গো জাহাজ।
ফেরি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু নাব্য সংকট নয়, পানি কমে যাওয়ায় সরু হয়েছে চ্যানেল। এতে সামান্য কুয়াশায় ফেরি চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তবে নৌপথ সচল রাখতে কর্তৃপক্ষ খনন করে যাচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিসি সূত্র জানায়, রো রো ফেরি স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে ৯-১০ ফুট পানির গভীরতা প্রয়োজন। নাব্য সংকটের কারণে প্রায় তিন মাস ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এখনও অনেক জায়গায় ডুবোচরে ফেরি আটকে যাচ্ছে। বর্তমানে দৌলতদিয়ার ৭টি ঘাটের মধ্যে ২টি পুরোপুরি সচল। বাকি পাঁচটি ঘাটের মধ্যে ১ নম্বর, ২ নম্বর, ৫ নম্বর ও ৬ নম্বর ঘাট ভাঙনের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ। শুধু ৩ ও ৪ নম্বর ঘাট দিয়ে যানবাহন পারাপার চালু রয়েছে। আর ৭ নম্বর ঘাটের কাছে খনন কাজ চলায় বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে।
দৌলতদিয়া ৭ নম্বর ফেরিঘাটে কর্তব্যরত বিআইডব্লিউটিসির কর্মচারী সোহেল রানা জানান, ঘাট-সংলগ্ন স্থানে পানির গভীরতা কম থাকায় ফেরি ভিড়াতে সমস্যা হচ্ছে। পন্টুনের তিনটি পকেটের মধ্যে একটি কোনোমতে সচল।
রো রো ফেরি এনায়েতপুরীর মাস্টার (চালক) মাসুদ আকন্দ বলেন, মাস দেড়েক আগে সরাসরি চলতে পারলেও এখন অনেক নিচ দিয়ে ঘুরে চলাচল করতে হচ্ছে। দৌলতদিয়ার ৭ নম্বর ঘাট বরাবর চ্যানেল একেবারে সরু। ঘুরে যেতে ফেরি পারাপারে ২০-২৫ মিনিট সময় বেশি লাগছে। এক মাস ৭ নম্বর ঘাটে ফেরি ভিড়াতে পারি না। নাব্য সংকট এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ড্রেজিং চলছে। তারপরও কাঙ্ক্ষিত নাব্য মিলছে না।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা অঞ্চলের ডিজিএম নাছির উদ্দিন বলেন, প্রায় তিন মাস ধরে নদীতে নাব্য সংকটের কারণে আরিচা-কাজীরহাট নৌপথে ফেরি চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ফেরি ডুবোচরে আটকে যাচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. সালাহউদ্দিন বলেন, খনন কাজ অব্যাহত আছে। বিআইডব্লিউটিএর প্রকৌশলীরা বিষয়টি দেখভাল করছেন।
বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং ইউনিটের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান আহমেদ বলেন, আরিচা-কাজীরহাট, নগরবাড়ী ও বাঘাবাড়ী নৌপথে সাতটি ড্রেজার দিয়ে পলি অপসারণ করা হচ্ছে। এবার প্রায় ৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩৮ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণ করা হবে। খনন করা পলি চ্যানেলের উজানে রাখা হয়েছে। এগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে পলি অপসারণ করা হচ্ছে একটি ড্রেজার দিয়ে। এ নৌপথে প্রতিবছর নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান ডিইডব্লিউ ড্রেজিং করে আসছে।
পলি নদীতে ফেলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদীতে খনন করা চ্যানেল থেকে ১২ থেকে ১৫ ফুট দূরে দৃশ্যমান চরে পলি ফেলা হচ্ছে। দূরে নদীর বাইরে পলি ফেলার সামর্থ্য নেই।
নাব্য সংকট নিরসনে শুধু ড্রেজিং করে লাভ হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (হাইড্রোলিক রিসার্চ) পিন্টু কানুনগো। তিনি বলেন, পদ্মা-যমুনা নদীতে বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে ঘোলা পনির সঙ্গে প্রচুর পলি আসে। এ কারণে নাব্য সংকট সৃষ্টি হয়। ড্রেজিং করে সাময়িক চ্যানেল সচল রাখা যায়। কিন্তু স্থায়ী সমাধান হবে না। স্থায়ী সমাধানে প্রয়োজন টেকসই নদীশাসন। দুই পাড় বেঁধে দিতে হবে।
- বিষয় :
- নদী