শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্বীকৃতি থামল ৫৬০ জনে
.
আবু সালেহ রনি
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:০৯
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পাঁচ শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও তাদের পরিবারের জন্য কোনো রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করা হয়নি। শুধু তাই নয়, নির্ধারিত হয়নি তাদের মর্যাদাক্রমও। এরই মধ্যে নতুন করে আর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বীকৃতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তাই স্বীকৃতির বাইরে থেকে যাচ্ছেন অন্তত ৬০০ শহীদ বুদ্ধিজীবী।
জানা গেছে, গত আগস্টে সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বীকৃতি প্রদান সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই কমিটি অকার্যকর রয়েছে। ওই কমিটিকে কার্যকর করার কোনো চিন্তাও মন্ত্রণালয়ের নেই। এ-সংক্রান্ত কমিটি ও সাব-কমিটির কাছে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জমা হওয়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নথিপত্র রয়েছে। এর আগে গত ২৪ মার্চ মন্ত্রণালয় থেকেই বলা হয়েছিল, যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত কমিটির কাছে ৬০০-৭০০ আবেদন জমা রয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর তাদের পরিবারের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করা হবে। কমিটি এ বিষয়ে প্রস্তাব দেবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সমকালকে বলেন, ‘৫৩ বছর পর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করাটা অত্যন্ত দুরূহ একটা ব্যাপার। অনেকের সন্তানসন্ততিও বেঁচে নেই। তাই নতুন করে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ করা হবে না।’ গেজেটভুক্ত শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা হবে কিনা– এ প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, এমন কিছু মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনায় নেই।
স্বাধীনতার পর থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী কারা এবং তাদের তালিকা প্রণয়ন করা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে। বেসরকারি উদ্যোগে কিছু তালিকা গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হলেও সরকারিভাবে সেটি হয়নি। ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে ১১ সদস্যের যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে আওয়ামী লীগ সরকার। মন্ত্রণালয়ের সচিবকে কমিটির সভাপতি করা হয়। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী প্রথম দফায় ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালের ২৯ মে দ্বিতীয় তালিকায় আসে ১৪৩ জন। এর পর তৃতীয় দফায় চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ১০৮ জন এবং চতুর্থ দফায় ২৪ মার্চ ১১৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামের গেজেট প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে গেজেটভুক্ত শহীদ বুদ্ধিজীবী মোট ৫৬০ জন।
চতুর্থ দফায় গত ২৪ মার্চ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রকাশের সময় মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আগামী ১৪ ডিসেম্বরের আগেই আমরা চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের লক্ষ্য নিয়েছি। আরও কিছু আবেদন রয়েছে। কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের সুপারিশ করলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’ মন্ত্রী তালিকা প্রকাশের পর গেজেটভুক্ত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে সেদিন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব ইশরাত চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সচিব ইশরাত চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘কমিটির সুপারিশ পাওয়া যায়নি। তাই এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কোনো সিদ্ধান্তও নেই।’ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মর্যাদা নির্ধারণ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নে সচিব বলেন, ‘এ বিষয়েও তালিকা প্রণয়ন-সংক্রান্ত কমিটির কোনো সুপারিশ পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ করে থাকে।’
জানতে চাইলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সমকালকে বলেন, ‘চতুর্থ দফার তালিকা প্রকাশের পর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কোনো বৈঠক হয়নি। তাই এর সর্বশেষ অবস্থা জানা নেই।’ পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির একাধিক সদস্য সমকালকে বলেন, বিভিন্ন উৎস থেকে প্রায় দুই হাজার শহীদ বুদ্ধিজীবীর তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৫৬০ জনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও কমিটির কাছে আরও ৬০০-৭০০ আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য রয়েছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কত?
মুক্তিযুদ্ধে কতজন বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছেন– এমন পূর্ণাঙ্গ তথ্য কোথাও নেই। তবে ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের এক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী ১ হাজার ৭০ জন। ১৯৭১-এর ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাও ফরমান আলী এ দেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউসে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে হত্যা করা।’
এ ছাড়া ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার নির্মিত ‘বাংলাদেশ’ নামক প্রামাণ্য চিত্রে বলা হয়, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে ৬৩৭ জন প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক, ২৭০ জন সেকেন্ডারি স্কুলশিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজ শিক্ষক শহীদ হয়েছেন।’ তবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটিসহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে হাজারো শহীদ বুদ্ধিজীবীর তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী, ৯ সাহিত্যিক ও শিল্পী, পাঁচজন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য পেশার দু’জন।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা নিয়ে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সংগ্রহের জন্য তখন বাংলা একাডেমি সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। এর পর বাংলা একাডেমি সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, প্রকাশকসহ বিশেষ বিশেষ পেশাজীবী ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে বিবেচিত হবেন। ওই নীতিমালা অনুযায়ী ১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর ২৫০ জনের তালিকা নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া ৩২৫ জনের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম সংগ্রহ করে পরে তাদের নিয়ে ‘স্মৃতি ৭১’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর সর্বশেষ দশম খণ্ডে স্মৃতি ৭১ প্রকাশিত হয়। এর পর আর এটি প্রকাশ করা হয়নি।
বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. এম এ হাসান সমকালকে বলেন, পাকিস্তানিরা শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে তা নয়, এটি শুরু হয়েছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। এর প্রধান লক্ষ্যবস্তু
ছিল প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন অনুপ্রেরণাদায়ী। এ জন্যই দেশব্যাপী টার্গেট করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। তাঁর মতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার বাংলাদেশ গড়তে হলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাসহ সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা জরুরি।
- বিষয় :
- শহীদ বুদ্ধিজীবী