ঢাকা সোমবার, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫

বিষমুক্ত আবাদে বদলে গেছে উত্তরের কৃষি

বিষমুক্ত আবাদে বদলে  গেছে উত্তরের কৃষি

রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত ভেষজ পদ্ধতি ও ভার্মি কম্পোস্ট প্রয়োগে শিম চাষাবাদ। বগুড়ার শাজাহানপুরের চুপিনগর ইউনিয়ন থেকে তোলা- সমকাল

 লিমন বাসার, উত্তরাঞ্চল 

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:১২

উত্তরের বিভিন্ন জেলায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে চলছে পরিবেশবান্ধব বিষমুক্ত সবজি চাষ। বগুড়া, রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর ও পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকায় দেখা মিলেছে এসব সবজি ক্ষেতের। কৃষকরাও এই চাষের মাধ্যমে শুরু করেছেন নতুন এক কৃষি আন্দোলন। চাষিদের ভাষ্য, যে খাবার বিপদ ডেকে আনে, তা তারা উৎপাদন করবেন না। বিষমুক্ত সবজি চাষের মাধ্যমে একদিকে জীবনযাত্রার পরিবর্তন হচ্ছে, অন্যদিকে বাজারে তাদের উৎপাদিত সবজির চাহিদাও বাড়ছে।
বগুড়ার শাজাহানপুরের চুপিনগর ইউনিয়নের কামারপাড়া ও জৈন্তপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দূরে সরিয়ে ভেষজ পদ্ধতি এবং ভার্মি কম্পোস্ট প্রয়োগে চাষাবাস করছেন। 
গেল মঙ্গলবার সকালে টমেটো ক্ষেতের পাশে বসে কাজ করছিলেন কৃষক আব্দুল মান্নান। ক্ষেতের এক পাশে গাছের ডালে ঝুলছে নিমপাতা ও পিতরাজ দিয়ে তৈরি প্রাকৃতিক কীটনাশকের বোতল। জমিতে জৈব সার ছিটাতে ছিটাতে তিনি বলেন, ‘আগে রাসায়নিক ব্যবহার করতাম। ফলন ভালো হলেও জমি শক্ত হয়ে মাটির প্রাণশক্তি হারিয়ে যেত। এখন কেঁচো সার আর ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করছি। মাটির উর্বরতা আবার ফিরে এসেছে। ফসলের গুণমানও বেড়েছে।’
কামারপাড়া গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির পাশে রয়েছে সিমেন্টের তৈরি রিং। এগুলোতে কেঁচো, গোবর ও খড়কুটো মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ভার্মি কম্পোস্ট। কৃষক আব্দুল মজিদ তাঁর বাড়ির পাশের রিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘গোবর আর কিছু জৈব উপাদান ব্যবহার করে আমরা কেঁচো সার তৈরি করি। এই সার জমিতে দিলে ফলন অনেক ভালো হয়।’
মনোয়ারা বেগম নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘আমরা নিজেরাই এই সার তৈরি করি। এটা শুধু খরচ কমায় না, জমির গুণগত মানও বাড়ায়। আগে যে জমিতে ১০০ কেজি ফসল হতো, এখন সেখানে ১২০ কেজি হচ্ছে।’

কৃষক কামরুল হাসান শোভন দেখালেন কীভাবে তারা ভেষজ উপাদান দিয়ে কীটনাশক তৈরি করেন। তিনি বলেন, নিমপাতা, বিষকাটালি আর থানকুনি পাতা মেশানো নির্যাস সবজির জমিতে স্প্রে করলে পোকামাকড় দূরে থাকে। এতে গাছ সুস্থ থাকে, ফলন বেশি হয়। মরিচ চাষের জন্য খ্যাতি আছে কামারপাড়া গ্রামের। ১০ শতাংশ জমির মরিচ চাষের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সাধারণত চাষ থেকে বাজারজাত পর্যন্ত একটি জমিতে খরচ হয় সাড়ে ৬ হাজার টাকা। এই জমি থেকে ফলন পাওয়া যায় ৪৮ থেকে ৫০ মণ। ৩০০ টাকা প্রতি মণ দরে বিক্রি করলেও এই মরিচের দাম পড়ে ১৫ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে লাভ থাকে সাড়ে ১১ হাজার টাকা। অন্যদিকে, অর্গানিক পদ্ধতিতে এই জমিটি চাষ করা হলে খরচ পড়ে তিন ভাগের এক ভাগ। 
পাইকার সালাম সওদাগর বলেন, ‘আমি এই গ্রাম থেকে নিয়মিত সবজি কিনি। ঢাকার বাজারে এই সবজি ভালো দামে বিক্রি হয়। ক্রেতারা বিষমুক্ত জিনিস খুঁজছেন, তাই এর দাম একটু বেশি হলেও কোনো অসুবিধা হয় না।’ তিনি বলেন, ‘রাসায়নিক সার দিয়ে উৎপাদিত সবজি অনেক সময় ঢাকা পৌঁছানোর আগেই পচে যেত। বিষমুক্ত সবজি টিকে থাকে, তাই এটি ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয়।’
পাশের আরডিএ বাজারে সবজি কিনতে আসা চাকরিজীবী মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘বিষমুক্ত সবজি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মুক্ত, এ কারণে আমরা নিশ্চিন্তে খেতে পারি।’
কৃষককে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে সহযোগিতা করে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক আব্দুল্লাহ বলেন, কীভাবে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি এবং ভেষজ কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়, সে ব্যাপারে আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।’
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবুর রহমান বলেন, ‘বিষমুক্ত চাষাবাদে শুধু কৃষকই লাভবান হচ্ছেন না, ক্রেতারাও স্বাস্থ্যসম্মত সবজি পাচ্ছেন। আমরা এই পদ্ধতি সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি।’

অন্য জেলায়ও বিষমুক্ত সবজি চাষ 
রংপুরের পীরগঞ্জ, মিঠাপুকুর, কাউনিয়ার কৃষকরাও এখন বিষমুক্ত সবজি চাষ করছেন। রংপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা কীটনাশক ছাড়া শাকসবজি চাষ করছেন। কৃষক মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা আগে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতাম, এখন জৈব সার ব্যবহার করি। এই নতুন পদ্ধতিতে চাষ করলে ফসলের গুণগত মান অনেক ভালো হয়, পরিবেশও দূষিত হয় না।
দিনাজপুরের হাকিমপুর, বিরল, নবাবগঞ্জ এলাকার কৃষকরা কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে সবজি চাষ করছেন। এখানে তারা ভার্মি কম্পোস্ট, গোবর সার এবং প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে জমির উর্বরতা বাড়াচ্ছেন। হাকিমপুরের কৃষক সেলিম উদ্দিন জানান, প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষ করলে জমি আরও সুস্থ থাকে এবং ফসলও ভালো হয়।
এদিকে পঞ্চগড়ের কিছু অঞ্চলে কৃষকরা বায়োফার্টিলাইজারের ব্যবহার করেছেন, যা পরিবেশবান্ধব এবং জমির উর্বরতা বজায় রাখে। স্থানীয় কৃষক জামাল উদ্দিন বলেন, আমরা কিছু প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে সবজি চাষ করি। এতে খরচ কম, ফলনও ভালো হয়। তাদের এই পদ্ধতি বর্তমানে অন্য কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

আরও পড়ুন

×