ঢাকা সোমবার, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫

জীবনের অফুরন্ত তরঙ্গে

জীবনের অফুরন্ত তরঙ্গে

হেলাল হাফিজ, ৭ অক্টো. ১৯৪৮–১৩ ডিসে. ২০২৪

নির্মলেন্দু গুণ

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৫১ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:৪৮

হেলাল হাফিজ আমার অনুজপ্রতিম, একই সঙ্গে অকৃত্রিম বন্ধু। হেলাল ও আমার দু’জনেরই বাড়ি নেত্রকোনায়। ওর বাবা খোরশেদ আলী ছিলেন কবি। ১৯৬০ সালে নেত্রকোনার ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। একই পত্রিকায় ১৯৬১ সালে আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় গেলে হেলালের বাবার সঙ্গে আমার দেখা হতো। 

সেখানেই বালক হেলালকে প্রথম দেখি। ১২-১৩ বছর বয়সী স্নিগ্ধ বালক; সে সময় হেলালের মা মারা যান। ওর বাবা আবার বিয়ে করেন। হেলাল সেই থেকে অনেকটা ঘরবিমুখী, বিবাগী হয়ে ওঠে।

সেই বালক হেলালই পরবর্তীতে কবি হেলাল হাফিজ। হেলালের সঙ্গে আবার আমার দেখা হয় ঢাকায়, ষাট দশকের শেষার্ধে, আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে তখন পূর্ববঙ্গ উত্তাল। হেলাল হাফিজ সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বাংলা বিভাগে পড়ে। থাকে ইকবাল হলে। আমার ও কবি আবুল হাসানের তখন ঢাকা শহরে নির্দিষ্টভাবে কোনো থাকবার জায়গা নেই। হেলাল হাফিজের ইকবাল হলের কক্ষটি আমাদের প্রায়ই থাকবার জায়গা হয়ে উঠল। হেলালের বাবার বন্ধু থেকে আমি হেলালের বন্ধু হয়ে উঠি।

সেই সময় আমার ও আবুল হাসানের দুর্দান্ত বোহেমিয়ান জীবন চলছে। হেলাল হাফিজ শামিল হয়ে গেল আমাদের নিশি জীবনে। আমরা সারারাত প্রায়ই ঘুমাই না, ঘুরে বেড়াই শহরের এ-প্রান্ত, ও-প্রান্ত। কবিতা ও জীবন খুঁড়ে খুঁড়ে আমরা দেখতে চাই এর ভেতরকার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। হেলাল স্মিতমুখে আমাদের পিছু পিছু ঘুরতে ঘুরতে কখন যেন অচ্ছেদ্য বন্ধুত্বে পরিণত হয়। আমরা তাকে ভরসা করতে শুরু করি। হেলাল নিজেকে কবি হিসেবে শান দিতে থাকে।

এর মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আসে। এক রাত্রিতে হাজার হাজার নিরস্ত্র ঘুমন্ত পূর্ববঙ্গবাসীকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। তার কিছুদিন আগে আমার চাকরি হয় দ্য পিপল পত্রিকায়। চাকরির প্রথম মাসের বেতন পেয়ে আমি একটি বালিশ ও থালা কিনে আজিমপুর টিনশেড মেসে উঠি। সেই প্রথম ঢাকায় আমার নিজের থাকবার জায়গা। ২৫ মার্চ রাতে সেখানেই ছিলাম। রাতে ক্র্যাকডাউনে হাজার হাজার মানুষের নিহত হবার ঘটনায় আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই– হেলালও সম্ভবত আর বেঁচে নেই। ইকবাল হলে অনেক নিহতের খবর পাই।

২৭ মার্চ সকালে কারফিউ ভাঙলে আমি সোজা ইকবাল হলে পৌঁছি হেলালকে খুঁজতে। সেখানে গিয়ে দেখি ভয়ংকর দৃশ্য। সারি সারি লাশ মেঝেতে, হলের ভেতরের মাঠে পড়ে আছে। অগণিত লাশ দেখে আমি অস্থির হয়ে ভাবতে থাকি, এই মৃত্যুপুরীতে হেলাল কীভাবে বেঁচে থাকবে! আমি উল্টানো মৃতদেহের মাথা ঘুরিয়ে লাশের মুখ দেখি– হেলাল কিনা! ঠিক সে সময় দেখি, জীবিত হেলাল হেঁটে আসছে। সে ২৫ মার্চ রাতে ফজলুল হক বা অন্য একটি হলে রাতে থেকে যাওয়ায় বেঁচে আছে। আমরা দু’জন পরস্পরকে দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করি। সেই কান্না ছিল হারানো ভাই ফিরে পাওয়ার কান্না। 

আর একমুহূর্ত সেখানে নয়। ইকবাল হল থেকে হেলাল হাফিজকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আমি ঢাকা ছেড়ে জিনজিরার দিকে চলে যাই। সেখানে এক রাত রাজনৈতিক নেতা মোস্তফা মোহসীন মন্টুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে পরদিন সুভাঢ্যার দিকে রওনা দিই। ২ এপ্রিল আমি নেত্রকোনার দিকে রওনা দিই; হেলাল ঢাকার দিকে ফেরে। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ঘটনাবলি আমাদের দু’জনকে বেশ কিছুদিনের জন্য পরস্পর থেকে আলাদা করে দেয়।

দীর্ঘ বিরতির পর আশির দশকে আবার আমাদের নিয়মিত দেখা হতে থাকে। প্রেস ক্লাবে আমি তাস খেলতাম; হেলাল পাশে বসে থাকতে থাকতে খেলা শুরু করে। ওর তাসের ভাগ্য ভালো। কালক্রমে চ্যাম্পিয়ন প্লেয়ার হয়ে ওঠে; এক পর্যায়ে তাস খেলাকে জীবিকাও বানিয়ে বসে। প্রেস ক্লাবের সদস্য হবার পর, সেটি তার বাড়িঘর হয়ে ওঠে। আশির দশকের মাঝামাঝি অনিন্দ্য প্রকাশের নাজমুল হক নতুন ধরনের কবিতার বই বের করতে আগ্রহী হয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমি তাকে কবি হেলাল হাফিজের কবিতার কথা বলি। বলি যে, চোখ বন্ধ করে হেলালের কবিতার বই বের করতে পারেন! প্রকাশিত হয়, ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। তার পরের কথা সকলেরই জানা। বিপুল পাঠক ভালোবাসায় গ্রহণ করে বইটিকে। হেলাল হাফিজ পাঠকনন্দিত কবি হিসেবে নিজেকে এক বইতেই সুপ্রতিষ্ঠিত করে।

অবশ্য এর পরও নিরিবিলি একাকী জীবনই যাপন ছিল হেলাল হাফিজের। প্রচণ্ড জনপ্রিয়তার জোরে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কবিতা লেখার ইচ্ছা তার হয়নি। তার কবিতার সংখ্যা তাই কম। হোটেলে একাকী বছরের পর বছর তার জীবন কেটে গেছে।

জানতাম, হেলাল হাফিজ অসুস্থ। আমারও বয়স হয়েছে। শরীর অনুকূলে থাকে না প্রায়ই। ইচ্ছা থাকলেও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠে না। হেলাল হাফিজের মৃত্যু সংবাদ আমাকে বিষণ্ন করছে। আমাদের একদা জীবন– জীবনের অফুরন্ত তরঙ্গে আমরা ছিলাম অচ্ছেদ্য, অভেদাত্মা; মৃত্যুতে তা বিলীন হবার নয়। হেলাল হাফিজ বেঁচে থাকবে তার কবিতায়। কবি হিসেবে তার নিজস্ব মনোভঙ্গি ও জীবনকে নানাভাবে দেখবার আকাঙ্ক্ষা থেকে সে বেঁচে থাকবে অনাদি দিনের বাংলা ভাষায়। আমরা যারা তাকে কাছ থেকে চিনতাম– নম্র স্বভাব, মিষ্টি ব্যবহারের জন্য হেলাল আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। হেলাল হাফিজের স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা।

আরও পড়ুন

×