ঢাকা শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

আপনি কি করোনার চতুর্থ ডোজের টিকা নিয়েছেন...

মোবাইলে প্রতারণার নতুন ফাঁদ

আপনি কি করোনার চতুর্থ  ডোজের টিকা নিয়েছেন...

প্রতীকী ছবি

 হাসনাইন ইমতিয়াজ

প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৭:২৩ | আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৭:২৩

মাহনুর ইসলাম কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। গতকাল বুধবার দুপুরে অফিসে কাজ করার সময় তাঁর ফোনে অপরিচিত নম্বর (+৮৮০৯৬৩৮৫৬৪৬৪৯) থেকে একটি কল আসে। কলটি ধরার পর মাহনুরের কাছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি বলতে থাকেন, ‘যাদের করোনার চতুর্থ ডোজ বাকি রয়েছে, তাদের নিবন্ধন চলছে। ফোনে একটি পিন কোড যাবে। সেটি জানালে নিবন্ধন সম্পন্ন হবে।’

এর পর মাহনুর তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে আসা কোড নম্বরটি ওই ব্যক্তিকে জানিয়ে দেন। এর কিছুক্ষণ পরই তিনি তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে প্রবেশ করতে পারছিলেন না। তখন প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি দ্রুত তাঁর মেইলসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করেন। এর আগের দিন মঙ্গলবার একই অফিসের আরেকজন একই ধরনের প্রতারণার সম্মুখীন হয়েছেন। শুধু এই দু’জনই নন; এমন প্রতারণার আরও খবর মিলছে।  

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত বছরগুলোয় জিনের বাদশা, মোবাইল ব্যাংকিং-এর নামে প্রতারণা করে লোকজনের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ শোনা যেত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান, গ্রাহকদের সচেতনতার কারণে এসব প্রতারণা কমে এসেছে। কিন্তু থেমে নেই প্রতারক চক্র। তারা এখন নানান ধরনের অভিনব ফাঁদ পেতেছে। কখনও চাকরি দেওয়ার কথা বলে, কখনও লটারি জেতার তথ্য জানিয়ে, হজযাত্রীদের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে লোকজনকে প্রতারণা করছে। উপবৃত্তি, বিধবা ভাতা, বৃদ্ধ ভাতার সুবিধাভোগীরাও এ ধরনের অনিয়মের সম্মুখীন হচ্ছেন।

টেলিকম খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এগুলো বেশির ভাগ স্পাম কল। লোকজনকে বোকা বানিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতেই প্রচারক চক্র এই কারসাজি করছে। তারা বলছেন, সচেতন হলে এই প্রতারণা থেকে বাঁচা সম্ভব। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

হজযাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা 

গত ২০ অক্টোবর এক বিজ্ঞপ্তিতে ধর্ম মন্ত্রণালয় জানায়, তাদের কর্মকর্তা পরিচয়ে ফোন করে একটি চক্র প্রতারণা করছে। হজের টাকা ফেরত দেওয়ার নাম করে চক্রটি হজযাত্রী, হজ এজেন্সির মালিক, প্রতিনিধি ও হজ গাইডদের ফোন করে তাদের ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, বিকাশ, নগদ ইত্যাদির তথ্য চাইছে। ওই চক্রের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ৯ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

৯৯৯ নম্বর ক্লোন

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বর ক্লোন করে বিকাশ বা অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের পিন নম্বর জানতে চাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর।

তারা বলছে, ৯৯৯ নম্বর থেকে কখনোই বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদির পিন নম্বর অথবা ব্যাংকের ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের পিন নম্বর জানতে চাওয়ার সুযোগ নেই। প্রতারক চক্র থেকে সতর্ক থাকতে হবে। গত ২৬ ডিসেম্বর পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর এসব তথ্য জানান।

ভাতাধারীও প্রতারিত হচ্ছেন

কার্ডধারী প্রত্যেক বিধবা প্রতি মাসে ৫০০ টাকা, বয়স্ক ৬০০ টাকা ও প্রতিবন্ধী ৮৫০ টাকা ভাতা পান। সেই হিসাবে তিন মাস পরপর তাদের টাকা দেওয়া হয়। এসব কার্ডধারীর মোবাইল ফোনে নগদ হিসাব নম্বরে ভাতার টাকা পাঠানো হয়। প্রতারক চক্র কৌশলে তাদের অনেকের কাছ থেকে সেই টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলা ইউনিয়নের দহপাড়া (আকন্দপাড়া) গ্রামের রোকেয়া বেগম প্রতিবন্ধী ভাতা পান। সম্প্রতি তিনি মোবাইল ফোনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তিনি জানান, ‘আমার মোবাইল ফোনে এক ব্যক্তি সমাজসেবা অফিসের লোক পরিচয় দিয়ে কল করে বলে, আমার নাকি নতুন ভাতা বই তৈরি হচ্ছে। বই নম্বরটা তাকে এসএমএস করে দিতে বলেছে। পরে আমার মোবাইল ফোনে একটা মেসেজ আসে। সেই মেসেজ তাকে জানালে দেখি, আমার টাকা নাই হয়ে গেছে। পরে এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি। কিন্তু আজও টাকা ফেরত পাইনি।’ এ ইউনিয়নের আরও কয়েকজন ভাতা সুবিধাভোগী এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা

চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। মোবাইল ফোন কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট পাঠানোর পাশাপাশি ফোন করেও চাকরির অফার দেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফোনদাতা নিজেকে কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কর্মী হিসেবে পরিচয় দেয়; কথা বলে ইংরেজিতে। কখনও কখনও আবার বাংলাদেশি কোনো ডিজিটাল এজেন্সি বা মার্কেটিং এজেন্সির কর্মী বলেও দাবি করে চক্রের সদস্যরা।

প্রতারকরা টেকনোলজি ব্যবহার করে

প্রতারকরা মূলত ‘ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল’-ভিওআইপি ব্যবহার করে প্রতারণার কলগুলো করে। এ প্রক্রিয়ায় ভয়েসকে ডিজিটাল সিগন্যালে রূপান্তর করে সেটা ইন্টারনেট প্রটোকলের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, মোবাইল ফোনে কল, এসএমএসসহ বিভিন্ন ধরনের অনলাইন প্রতারণার সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা কিছু অ্যাপের মাধ্যমে অন্য কারও নম্বর ব্যবহার করে কল দেয়। এটাকে স্পুফিং বলে। এ ছাড়া সিমকার্ড ক্লোনিংয়ের মাধ্যমেও এ ধরনের প্রতারণা কার হচ্ছে।

বক্তব্য

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির সমকালকে জানান, তিনি নিজেও এমন ফোন পেয়েছেন। তাঁর সঙ্গে ইংরেজিতে কথাও বলেছে। তিনি চাকরি পেয়েছেন– এমন অফার করে ১ হাজার টাকা ফি দিয়ে নিবন্ধন করতে বলা হয়। সুমন আহমেদ বলেন, আগে যেমন জিনের বাদশা পরিচয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হতো, এগুলোও সেই প্রতারকদের কাজ। এই প্রতারণা রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর হতে হবে। পাশাপাশি বিটিআরসিকে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ্ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, সুরক্ষা অ্যাপস থেকে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হওয়ার সুযোগ নেই। আর আমাদের করোনা টিকা কার্যক্রমও অনেক আগে শেষ হয়েছে। অন্য কোনো মাধ্যম থেকে তথ্য নিয়ে প্রতারকরা এমন অপকর্ম করছে।
মোবাইল ফোন অপারেটর রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদুল আলম সমকালকে বলেন, এই স্পাম কলগুলো তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে না। তবে প্রতারণা করতে পারে। এ ধরনের অভিযোগ পেলে তারা তদন্ত করে নম্বরগুলো বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, গ্রাহকদের সচেতন হতে হবে। সন্দেহজনক নম্বর থেকে ফোন এলে রিসিভ করার প্রয়োজন নেই। তাহলে জালিয়াতি কমবে।

জানতে চাইলে ডিএমপির মুখপাত্র উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সমকালকে বলেন, কোনো নাগরিকের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনা ঘটলে সেটা নিকটস্থ থানায় জানানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। ব্যক্তিকেন্দ্রিক অপরাধের বিষয়টি পুলিশকে জানালে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়। তিনি বলেন, কাউকে সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কোনো ব্যক্তিগত তথ্য চাইলে না দেওয়ার অনুরোধ রইল।

আরও পড়ুন

×