বিবিসির প্রতিবেদন
বিসিএসের প্রজ্ঞাপনে ২২২ জন কেন বাদ পড়লেন, জানেন না কেউ
ছবি: ফাইল
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৮:২৪
বাংলাদেশে ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সরকারি চাকরিতে ক্যাডার হিসেবে নিয়োগের জন্য প্রথম দফায় যাদের গেজেটভুক্ত করা হয়েছিলো, তাদের মধ্যে ১৬৮ জনের নাম বাদ দিয়ে নতুন গেজেট প্রকাশের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এই ১৬৮ জনের মধ্যে অন্তত ৭১ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, মানে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত ১৫ই অক্টোবর যখন প্রথম দফার গেজেট প্রকাশ হয় সে সময়েই ৯৯ জনকে বাদ দিয়ে গেজেট করেছিলো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তখন যাদের বাদ দেওয়া হয়েছিলো তার মধ্যে ৪৫ জন স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। আর বাকি ৫৪ জন সরকারের ইচ্ছাতেই বাদ পড়েছিলো।
আর প্রথম গেজেট থেকে কাটছাঁট করে আরও ১৬৮ জনকে বাদ দিয়ে সোমবার দ্বিতীয় গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে এই বিসিএসে সব মিলিয়ে মোট ২২২ জন উত্তীর্ণ হয়েও বিভিন্ন ক্যাডারের চাকরিতে যোগদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
যারা বাদ পড়েছেন তাদের অনেকে বিবিসি বাংলার কাছে তাদের ক্ষোভ ও হতাশার কথা জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা প্রথম দফায় গেজেট হওয়ার পর তাদের পুরনো চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। বাদ পড়াদের অনেকেই মনে করছেন তারা ‘কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর খামখেয়ালিপনার’ শিকার হয়েছেন।
নিয়মানুযায়ী, বিসিএস পরীক্ষা ও যাচাই বাছাইয়ের সব ধাপ শেষে সরকার উত্তীর্ণদের চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে থাকে। গেজেট প্রকাশের আগে পুলিশ ভেরিফিকেশনে প্রায় প্রতি বছরেই অল্প সংখ্যক হলেও বাদ পড়ার ঘটনা বহু বছর ধরে ঘটে আসছে। কিন্তু গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পর ফৌজদারি অপরাধ না করলে বাদ পড়ার ঘটনা বিরল। কারণ, চূড়ান্তভাবে যাদের নাম গেজেটে থাকে তারাই চাকরিতে যোগ দিয়ে থাকেন।
সরকারি কর্মকমিশন বা পিএসসির একাধিক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বক্তব্য পাওয়া যায়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকেও।
যারা বাদ পড়েছেন তারা যা বলছেন
একটি বিসিএস পরীক্ষার সব ধাপ পেরোনোর পর পুলিশি তদন্ত শেষে নিয়োগ পাওয়ার পর এতো বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দফায় গেজেট প্রকাশের ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন’ ও ‘একটি রেকর্ড’ বলে বর্ণনা করছেন অনেকে।
একই সরকারের আমলে একবার চাকরির জন্য মনোনীত করে পরে কেন আবার তাকে বাদ দেওয়া হলো- এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
তবে কেন এতজনকে বাদ দেওয়া হলো সে সম্পর্কে নতুন প্রজ্ঞাপনে কিংবা আলাদা করে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি সরকার।
ঝিনাইদহের শৈলকূপার মেয়ে মোসাম্মৎ নাসরিন সুলতানা প্রথম গেজেটে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তৃতীয়বারের মতো বিসিএস দিয়ে এবারই প্রথমবারের মতো উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি।
বিবিসি বাংলাকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের বংশে কেউ পড়ালেখাই জানে না। আমি গ্রামের প্রথম ঢাবি গ্রাজুয়েট। প্রথম বিসিএস গেজেটেড। আমাদের সবাই কৃষিকাজ করে। বিভিন্ন এনজিও’র স্কলারশিপ নিয়ে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করেছি। আমার কেন এই ক্ষতি করা হলো?’
মিজ সুলতানা জানান, তিনি একটি বেসরকারি চাকরি করতেন। কিন্তু প্রথমবার গেজেটভুক্ত হওয়ার পর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করবেন বলে সেই চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাবা গরিব মানুষ। বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। আমরা তিন বোন। ভাই নেই। বড় আপা কষ্ট করে পড়ালেখা করেছে। মা ১০ বছর ধরে অসুস্থ। বাবা-মা কান্না করছে। কোনোভাবেই এই অন্যায় তারা মানতে পারছে না।’
কাস্টমস ক্যাডারে নিয়োগের জন্য গেজেটভুক্ত হয়েও নতুন গেজেটে বাদ পড়েছেন এমন একজন কথা বলেছেন বিবিসি বাংলার সঙ্গে।
নিজের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আমি তিনবার গণিত অলিম্পিয়াডে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। শীর্ষ পর্যায়ে ছিলাম ফিজিক্স অলিম্পিয়াডেও। বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে ভারতে বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলাম।’
রাজউক উত্তরা মডেল থেকে এইচএসসি পাশের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক’ ইউনিটে তৃতীয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক’ ইউনিটে ১০ম ও বুয়েটে ২০৩ম স্থান অধিকার করেছিলেন ভর্তি পরীক্ষায়।
হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘পরে বুয়েটে পড়লাম। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইবিএ থেকে এমবিএ করেছি। বুয়েটে ডিনস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপসহ অফার ছিলো, কিন্তু যেতে পারিনি। বিসিএস দিয়ে চাকরি পেলাম ও গেজেটভুক্ত হলাম। সেখান থেকে আমাকে বাদ দেওয়া হলো। রাজনীতি করিনি কখনো। কারও তো ক্ষতিও করিনি।’
বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে এবার নিয়োগ পেয়েছিলেন নয় জন। এর মধ্যে দ্বিতীয় গেজেটে নাম নেই তিন জনের। এই তিন জনের মধ্যে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া একজন জানান, তার মা ক্যান্সারের রোগী।
‘এই চাকরির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিন, আমি বা আমার পরিবারের কেউ কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। কখনো আইন ভঙ্গের মতো কোনো কাজও করিনি। আমি কেন অন্যায়ের শিকার হবো?’ বলছিলেন তিনি।
গাইবান্ধা জেলার যতজন নিয়োগ পেয়েছিলেন প্রথম গেজেটের মাধ্যমে তাদের মধ্যে চার জনকে দ্বিতীয় গেজেটে রাখা হয়নি। এর মধ্যে একজন প্রশাসন ও অন্য তিন জন শিক্ষা ক্যাডারের। এই তিন জনের একজন হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা এম এ হান্নান সরকার।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, ‘এটাই আমার শেষ বিসিএস ছিলো। আমি জানতে চাই, কেন একবার নিয়োগ পেয়েও আবার বাদ পড়লাম। আমি বা আমার পরিবারের কেউ কখনো রাজনীতি করিনি।’
রাজনীতিমু্ক্ত হিসেবে পরিচিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা সাদিয়া আলম প্রথম গেজেটে কৃষি ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমার বাবা আওয়ামী লীগের সমর্থক। কিন্তু কখনো সক্রিয় ছিলেন না। আমি বিবাহিত। ঝিনাইদহে আমার শ্বশুড়বাড়ি। আবার দু’বার গেজেট হলো এই সরকারের সময়েই। একটিতে আমার নাম ছিলো। কিন্তু দ্বিতীয়টিতে নেই। এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমি তো রাজনীতি করিনি, কষ্ট করে এতদূর এসেছি।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘বাসায় থেকে পড়াশোনা করেছি। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না। দ্বিতীয় গেজেটে কেন বাদ পড়লাম জানি না। এমনটা কেন এলো?’
পরীক্ষার সব ধাপ ও প্রক্রিয়া শেষে অক্টোবরের গেজেটে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য নিজের নাম দেখে আগের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন দিবেন্দু সিংহ সপ্ত।
তিনি বলেন, ‘খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। তাই গেজেট হওয়ার পর আগের চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। বাদ দেওয়ার কারণ যদি রাজনীতি হয়, আমি তো কোনোদিন রাজনীতি করিনি। পরিবারেও কেউ করে না। সবাই সরকারি চাকরি করে। আমার জানার ইচ্ছা যে কেন আমাকে বাদ দেওয়া হলো।’
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলছেন, সবকিছু যাচাই বাছাই করেই প্রথম দফায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্ম, এলাকা, লিঙ্গ, বর্ণ বা রাজনৈতিক মতের কারণে কাউকে বাদ দেওয়া ‘ভয়াবহ অন্যায়’।
তিনি আরও বলেন, ‘এত ধাপ ও বাছাই প্রক্রিয়া পার হয়ে এত বড় সংখ্যা বাদ পড়ার ঘটনা দুঃখজনক। এটা কেন হবে? এটা রাষ্ট্রযন্ত্রেরই একটা দুর্নীতি। যদি কোনো বিশেষ কারণে কাউকে বাদ দিতে হয়- সেটি সুস্পষ্ট করে বলা উচিত। নিয়োগে স্বচ্ছতা জরুরি।’
তার মতে, প্রশ্ন ফাঁস কিংবা বিশেষ কোনো ফেভার পাওয়ার ঘটনা কিংবা কেউ কোনো অপরাধে জড়ালে তাকে বাদ সরকার দিতে পারে। কিন্তু সেটি দেশবাসীকে জানাতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেকজন শিক্ষক শারমিন আহমেদ বলছেন, ‘একবার গেজেটভুক্ত হওয়ার পর ফৌজদারি অপরাধ ছাড়া কিংবা কারণ দর্শানো ছাড়া এভাবে বঞ্চিত করার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তরুণদের ওপর। তার মতে এটি শিক্ষার্থীদেরও পড়াশোনার স্পৃহাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রথমবার পরীক্ষা ও যাচাই বাছাই শেষে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো তাদের সবাইকেই চাকরিতে রাখা উচিত, যদি না কারও বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অপরাধ কিংবা আইন ভঙ্গের অভিযোগ না পাওয়া যায়। নয়তো স্বচ্ছতা, আইনের শাসন ও পিএসসির কাজের যে প্রক্রিয়া সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
তার মতে, এভাবে ইচ্ছে মতো যাকে খুশি বাদ দেয়ার সংস্কৃতিটা যারা বাদ গেলো শুধু তাদের জন্যই নয় বরং যারা চাকরি করছে তাদের জন্যও এটা অশনিসংকেত।
ঢাবি শিক্ষক শারমিন আহমেদ বলেন, ‘কারণ ব্যক্তি ইচ্ছায় যে কেউ চাকরি হারাতে পারে। সব মিলিয়ে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এটি অস্থিরতা বাড়িয়ে দেবে এবং মেধাবীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করবে।’
৪৩ তম বিসিএস সম্পর্কে যত তথ্য
পিএসসি ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিলো ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর। এরপর আবেদন, প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৪৩তম বিসিএস থেকে ২ হাজার ৮০৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছিলো পিএসসি।
এরপর যাচাই বাছাই শেষে গত ১৫ই অক্টোবর ২০৬৪ জনকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দিয়ে প্রথম গেজেট প্রকাশ করেছিলো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এরপরই এই গেজেটে যাদের নাম ছিলো তাদের চাকরিতে যোগদানের কথা। কিন্তু সোমবার নতুন করে আরও ১৬৮ জনকে বাদ দিয়ে মোট এক হাজার ৮৯৬ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হলো।