অগ্নিকাণ্ডের মামলা তদন্তে গিয়ে হয় ‘পানি’
.
বকুল আহমেদ
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:৩৭ | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৯:০৪
অগ্নিকাণ্ড ঘটলে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। হতাহতের ঘটনায় ফৌজদারি মামলা হয় থানায়। এসব মামলার তদন্ত করতে সময় পার হয়। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় দায়ীরা। বিচার পায় না ভুক্তভোগী পরিবার। গত দুই বছরে রাজধানীর বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের মামলা বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য মিলেছে।
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড
সর্বশেষ ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ছয় থেকে ৯ তলা পর্যন্ত পুড়ে যায়। আগুনে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও পুড়েছে জরুরি কাগজপত্র। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী সচিবালয়ের সামনের সড়কে ট্রাকচাপায় প্রাণ হারিয়েছেন।
বেইলি রোডের তদন্ত শেষ হয়নি
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজে’ আগুনে নারী-শিশুসহ ৪৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। তাড়াহুড়া করে কিংবা লাফ দিয়ে বের হতে গিয়ে আহত হন শতাধিক মানুষ। ওই ঘটনায় রমনা থানায় একটি মামলা হয়। এটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রথমে তদন্ত শুরু করেন সিআইডির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ। গত জুনে তিনি বদলি হওয়ার পর দায়িত্ব পেয়েছেন একই ইউনিটের পরিদর্শক শাহজালাল মুন্সী। ঘটনার ১০ মাসেও তদন্ত শেষ হয়নি।
সিআইডির তদন্তকারী পরিদর্শক শাহজালাল মুন্সী সমকালকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত আটজন গ্রেপ্তার হয়েছে, যারা ওই ভবনের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের মালিক ও কর্মচারী। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। খুব শিগগির আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তদন্তাধীন মামলার বিষয়ে এর চেয়ে বেশি তথ্য দেওয়া যাবে না।’
ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রতিবেদন জমা দেয়। তাতে উঠে আসে, ভবনের বিভিন্ন তলায় রেস্টুরেন্ট ও কফিশপ। যে কারণে ওই রাতে বিপুল সংখ্যক মানুষ সেসব প্রতিষ্ঠানে খাওয়ার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল নিচতলায় চা-কফির দোকানের ইলেকট্রিক কেটলি থেকে। আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। সেখানে কাচ্চি ভাইসহ বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বিপুল সংখ্যক গ্রাহক ছিল। ভবনের একটিই সিঁড়ি, সেখানে সিলিন্ডার রাখা ছিল। এ কারণে মানুষ নামতে পারেনি। ফলে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়।
ক্যাফে কুইনের তদন্তে তিতাসের বিলম্ব
২০২৩ সালের ৭ মার্চ পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে ‘ক্যাফে কুইনে’ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ২৬ জন নিহত হন। এর মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। বাকি ছয়জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সাততলা ভবনের বেজমেন্ট, নিচতলা, দোতলা ও তৃতীয় তলা ধসে পড়ে। বেজমেন্ট থেকে শক্তিশালী বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। অবৈধভাবে বেজমেন্টে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করা হয়েছিল। আলো-বাতাস বের হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না সেখানে। এ ঘটনায় বংশাল থানায় একটি মামলা হয়। মামলাটি তদন্তের জন্য স্থানান্তর করা হয়েছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে। পরে তদন্তের দায়িত্ব পায় সিটিটিসির ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। আজও পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।
এ বিষয়ে তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, ভবনটির মালিক দুই ভাই ওয়াহিদুর রহমান ও মতিউর রহমান এবং বেজমেন্টের স্যানিটারি ব্যবসায়ী আব্দুল মোতালেব মিন্টুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ভবনটি আবাসিক। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেওয়ার কোনো অনুমতি ছিল না। নির্মাণবিধি না মেনে বেজমেন্টে দোকান ভাড়া দিয়েছিলেন মালিক। সেখানে রাখা হয়নি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। এ ছাড়া দোকানে অরক্ষিতভাবে রাসায়নিক মজুত করেছিলেন। গ্যাস লিকেজ হলেও তিতাস কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্যাস লিকেজ থেকে আগুনের সূত্রপাত। দোকানে রাসায়নিক থাকায় বিস্ফোরণ ঘটে। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। তিতাসের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় তাদের অবহেলা থাকায় তথ্য দিতে বিলম্ব করছে। সেটি হাতে পেলে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
পৌনে দুই বছর পর বঙ্গবাজারে অগ্নিসংযোগের মামলা
তৈরি পোশাকের অন্যতম পাইকারি মার্কেট বঙ্গবাজারে ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে আগুন লাগে। প্রথমে আদর্শ মার্কেটে আগুন লাগলেও মুহূর্তে তা বঙ্গবাজার, গুলিস্তান ও মহানগর মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে পাশের এনেক্সকো টাওয়ার, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, বঙ্গ ইসলামিয়া সুপারমার্কেট ও বরিশাল প্লাজা আংশিক পুড়ে যায়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। আগুন নেভাতে সময় লাগে ৭৫ ঘণ্টা। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ (ডিএসসিসি) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে।
ডিএসসিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডে ৩০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক অনুমান করা হয়। আগুনে মোট ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আগুন লাগার কারণ হিসেবে সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটি জানায়, মার্কেটের তৃতীয়তলায় একটি এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। সিগারেটের আগুন অথবা মশার কয়েল থেকে আগুন লাগে।
অগ্নিকাণ্ডের পর বঙ্গবাজারের পাশে অবস্থিত ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তরে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। এ ঘটনাসহ সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে বংশাল থানায় দুটি মামলা হয়। একটির বাদী পুলিশ এবং অন্যটির বাদী ফায়ার সার্ভিস। দুটি মামলায় পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। ঘটনার এক বছর ৯ মাস পার হতে চলল, অথচ মামলার তদন্ত শেষ হয়নি।
একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বংশাল থানার এসআই শেখ আলী আজহার সমকালকে বলেন, তিনি মামলার ৩ নম্বর তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্ত চলছে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আরেক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বংশাল থানার এসআই পলাশ চৌধুরী জানান, কিছুদিন আগে তিনি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন। এ মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা তিনি। এই মুহূর্তে তদন্ত সম্পর্কে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না।
বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় পৌনে দুই বছর পর ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আসামি রয়েছে ১২ জন। পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়েছিল বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। গত ২২ নভেম্বর ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে মিরপুরের বাসিন্দা কামাল হোসেন রিপন ৫০০ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগ এনে শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন।
ফজলে নূর তাপস ছাড়াও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য আফজাল হোসেন, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন রতন, আওয়ামী লীগ নেতা আতিকুর রহমান, জহিরুল ইসলাম, মোহন ঢালী, মনোয়ার হোসেন মনু, লোকমান খান, বেলায়েত হোসেন, রুবেল, হুমায়ুন কবির, শাহাবুদ্দিন ও আব্দুল হান্নানকে আসামি করা হয়।
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মুনসুর সমকালকে বলেন, মামলাটির তদন্ত চলছে।
ধীর তদন্তে ন্যায়বিচার নিয়ে হতাশা
বেইলি রোডে আগুনে নিহতের তালিকায় ছিলেন কক্সবাজারের উখিয়ার বাসিন্দা কাস্টমস কর্মকর্তা শাহজালাল উদ্দিন, তাঁর স্ত্রী মেহেরুন আফরোজ হেলালি মিনা এবং তাদের একমাত্র সন্তান তিন বছরের ফাইরুজ কাশেম জামিরা। নিহত শাহজালালের বড় ভাই শাহজাহান সাজু সমকালকে বলেন, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। ঘটনার ১০ মাস পার হলেও তদন্ত শেষ হয়নি। তদন্তের ধীরগতিতে ন্যায়বিচার নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আমরা আদৌ বিচার পাব কিনা, জানি না। এর পরও প্রত্যাশা করি, দ্রুত তদন্ত শেষ করে আদালতের মাধ্যমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। তিনি আরও বলেন, বেইলি রোডের রেস্টুরেন্টের কোনো অনুমতি ছিল না। আর যাতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড না ঘটে, সেজন্য ঢাকাসহ সব রেস্টুরেন্ট সরকারি নিয়মকানুন মেনে গড়ে উঠুক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী আমিনুল গণি টিটো সমকালকে বলেন, ‘তদন্তের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হলেও পুরোনো ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য স্মরণ করে উপস্থাপন করতে পারেন না। এটা আসামি পক্ষকে খালাস পেতে সহায়তা করে। ভুক্তভোগী পরিবার ন্যায়বিচার পাবে কিনা, তা নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে।’
- বিষয় :
- অগ্নিকাণ্ড