ঢাকা রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

শীত-কুয়াশার দাপটে জবুথবু জনজীবন

শৈত্যপ্রবাহ ১৩ জেলায়, থাকবে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত

শীত-কুয়াশার দাপটে জবুথবু জনজীবন

দেশের ১৩ জেলায় শুরু হয়েছে শৈত্যপ্রবাহ। এর মধ্যে রাজশাহী একটি। শীতের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয় কনকনে ঠান্ডা বাতাস। ভারী কাপড়ে শরীর মুড়িয়ে কাজে বের হচ্ছেন মানুষ। শুক্রবার দুপুরে নগরীর বুধপাড়া থেকে তোলা শরিফুল ইসলাম তোতা

সমকাল প্রতিবেদক 

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:৪২ | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৮:৫৪

উত্তর গোলার্ধে এখন দিনের ব্যাপ্তি ছোট, রাত বড়। দুপুর ১২টার পরই প্রকৃতির রূপ হয়ে যায় কোমল। এ সময় তাপমাত্রাও কমে আসে। জেঁকে বসে কুয়াশা। এর সঙ্গে খানিকটা হালকা শীত। কিন্তু নতুন বছরের শুরু থেকেই শীতের হিসাবনিকাশ কিছুটা পাল্টে গেছে। কয়েক দিন ধরে সূর্যের দেখা মিলছে না, দিনেও রাতের মতো ঠান্ডা ও কুয়াশা পড়ছে। দিনের ব্যাপ্তি ছোট হওয়া এবং সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ফারাক কমে আসায় শীতের কাঁপন থাকছে সারাদিন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো ঢাকায়ও বেড়েছে শীত। গতকাল সারাদেশের মধ্যে ঢাকা এবং এর আশপাশে সবচেয়ে বেশি শীত অনুভূত হয়েছে। এর পরই আরিচায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শীত অনুভূত হয়েছে। 

গতকাল দেশের ১৩ জেলার ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। ঠান্ডার সঙ্গে জুটি বেঁধেছে ঘনঘোর কুয়াশা। এতে স্থবিরতা নেমে এসেছে জনজীবনে। নিম্ন আয়ের মানুষের বিপত্তি বেড়েছে। কারণ, তাদের এই শীতেও কাজের সন্ধানে বাইরে বেরোতে হয়েছে। ঘন কুয়াশার কারণে যানবাহন চলাচলে বিপত্তি দেখা দিয়েছে অনেক স্থানে। শীতজনিত নানা অসুখে হাসপাতালে রোগী বেড়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, শুক্রবার রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, নওগাঁ ও কুষ্টিয়া এবং রংপুর বিভাগের আট জেলায় বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। আজ শনিবার তাপমাত্রা কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও কুয়াশা পুরোপুরি কাটতে আরও তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে। ধাপে ধাপে পুরো ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত শৈত্যপ্রবাহ থাকতে পারে। 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, জানুয়ারি শীতের মাস; ঠান্ডা কমার সুযোগ নেই। সামনে আরও বাড়তে পারে। কখনও সূর্য উঠলে ঠান্ডা কম লাগবে, তার পর রোদ চলে গেলে আবার বাড়বে– এমনই চলতে থাকবে। জানুয়ারিতে এক থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি এবং এক থেকে দুটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে।

রেলপথে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সারাদেশে শীতার্ত ও দুস্থদের মাঝে বিতরণ করতে ৬ লাখ ৭৯ হাজার কম্বল দেওয়া  হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিল থেকে। এ ছাড়া শীতার্তদের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৩৩ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বলে গতকাল মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। 

যে কারণে শীতের অনুভূতি বেশি 
স্বাভাবিকভাবে শীতকালে দিন ও রাতে (সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন) তাপমাত্রার পার্থক্য থাকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পার্থক্য ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে চলে এলে শীতের অনুভূতি বাড়তে থাকে। ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে শীতের অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এই পার্থক্য অঞ্চলভেদে ২ দশমিক ২ থেকে ৬ ডিগ্রিতে নেমে এসেছে। দেশের যে অঞ্চলে পার্থক্য যত কম, সেখানে শীতের তীব্রতা তত বেশি। গতকাল দেশের সর্বনিম্ন ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে সারাদেশের মধ্যে ঢাকা এবং এর আশপাশে সবচেয়ে বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে।

গতকাল ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান মাত্র ২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাশাপাশি আরিচায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান ২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ কারণেই ঢাকায় বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে। আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান যত কমবে, ততই বেশি শীত অনুভূত হবে।

তাপমাত্রা আট থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ছয় থেকে আট ডিগ্রিতে নামলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ আর চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়। আর তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে হয় অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ।

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের পর শীত কমে আসবে বলেও জানান আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ। তিনি বলেন, আগের থেকে শীতের সময় কমে এসেছে। আগে দেখা যেত ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারিতে শীত থাকত। এখন দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বরে সেভাবে শীত আসে না। জানুয়ারিতে থাকে। ইদানীং শৈত্যপ্রবাহেরও সংখ্যা কমেছে। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে শীতের তীব্রতা বেড়েছে।

আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, লম্বা সময় ধরে ঘন কুয়াশা পড়লে সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে পড়ার সুযোগ পায় না। ফলে তা ভূমিকে উত্তপ্ত করতে পারে না এবং শীত বেশি লাগে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা বাতাসের কারণেও শীত বেশি অনুভব হয়। 

হাসপাতালে বাড়ছে রোগী 
শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে বাড়ছে রোগী ও স্বজনের আনাগোনা। বেশির ভাগই লড়াই করছে তীব্র ঠান্ডার সঙ্গে। বয়স্কদের অবস্থাও বেহাল। শীত না পড়তেই ভর্তি হতে হয়েছে হাসপাতালে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক সকরা আফরিন এ জাহান জানান, আগে থেকে সতর্কতার অভাবে ওয়ার্ডগুলোয় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। তাই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঘরে ব্যবস্থা রাখতে হবে। 

রাজধানীসহ সারাদেশে জনজীবন বিপর্যস্ত 
শুধু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়া জেলাগুলোতেই নয়, রাজধানীসহ দেশের প্রায় সর্বত্রই আজ তীব্র শীতের প্রকোপ ছিল। শীতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ফুটপাতে বসবাস করা ছিন্নমূল মানুষ। শীতল বাতাসে পাতলা কম্বল জড়িয়ে কোনো রকম শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন তারা। অনেকের কপালে তাও জোটেনি। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলি ঘুরে মানবেতর এ চিত্র দেখা যায়। অনেকেই রাতে না ঘুমিয়ে আগুনের পাশে বসে রাত কাটাচ্ছেন আর ঘুমাচ্ছেন দিনের বেলা।

মিরপুর ১২ নম্বর এলাকায় ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে রিকশায় বসে ছিলেন জাকির হোসেন। এই রিকশাচালক বলেন, ‘চালাইতে গেলেই যে বাতাসটা আইয়া শরীর কাঁপতে থাকে। একটা পাতলা শীতের কাপড় পরছি ভেতরে, এর বেশি তো আর নাইও।’ 

পঞ্চগড়ে দিনমজুর, কৃষি শ্রমিক, পাথর শ্রমিক, রিকশা-ভ্যানচালকসহ খেটে খাওয়া মানুষের ওপর বেশি দুর্ভোগ নেমে এসেছে।

পাবনার ঈশ্বরদীতে গতকাল চলতি মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে। শীতের প্রকোপে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ‘রোটা ভাইরাস’ নামের এক ভাইরাসে শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।

পিরোজপুরে ঘন কুয়াশার সঙ্গে বইছে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। গতকাল শহরের বেশির ভাগ দোকানপাট ছিল বন্ধ। রাস্তাঘাটেও মানুষের উপস্থিতি কম। কনকনে শীতে বিপাকে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীরা।

তীব্র শীত, ঘন কুয়াশা ও হিমেল হাওয়ায় কাঁপছে গাইবান্ধার মানুষ। ঠান্ডায় কাজকর্ম হারিয়ে অলস সময় পার করছে চরাঞ্চলসহ দিনমজুর শ্রেণির মানুষ। শীতে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে কৃষকের ধানের বীজতলায়ও।

গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালের শিশু চিকিৎসক ডা. এ কে আজাদ বলেন, গত তিন দিনের শীতে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। এর মধ্যে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেশি। 

উত্তরের হিমেল হাওয়া ও কনকনে ঠান্ডায় কুড়িগ্রামে জেঁকে বসেছে শীত। ঘন কুয়াশার কারণে দিনের বেলায়ও হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহনগুলো চলাচল করছে। 
রংপুর শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলসহ নদীপারে শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। শীত নিবারণে গরম কাপড় না থাকায় ছিন্নমূল আর হতদরিদ্র পরিবারগুলোর মানুষ খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। বাড়ছে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্টসহ শীতজনিত রোগ।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধি)

আরও পড়ুন

×