ঢাকা রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

সড়ক দুর্ঘটনায় সাজানো মামলা

ঘটনাস্থলে না থেকেও আসামি, গণপিটুনির পর গ্রেপ্তার

মামলায় আসামির পর বুয়েটের প্রকৌশলী শহিদুলসহ তিনজন কারাগারে

ঘটনাস্থলে না থেকেও আসামি, গণপিটুনির পর গ্রেপ্তার

প্রকৌশলী শহিদুল

সাহাদাত হোসেন পরশ 

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:৪৪ | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৮:৪৭

২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সোয়া ৬টা। পটুয়াখালী-মির্জাগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের ২ নম্বর সেতুসংলগ্ন সিকদার বাড়ির সামনে মর্মন্তুদ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় মোটরসাইকেল আরোহী এক ছাত্র। তার নাম নেয়ামুল হক নাফিস (১৭)। সে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় তার বন্ধু নাভিদ ইসলাম সাফিন (১৭) ও ফারাবি হাসান (১৭) আহত হয়। ঘটনাটি ঘিরে পরবর্তী সময়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে।

সমকালের অনুসন্ধান বলছে, দুর্ঘটনাস্থলে না থেকেও গত সোমবার এর জেরে গণপিটুনির শিকার হন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করা প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম (৫৪)। এর পর তাঁকে উদ্ধার করে যৌথ বাহিনী। ‘সাজানো’ মামলায় শহিদুলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। দুর্ঘটনার সময় গাড়িতে ছিলেন না তিনি; নিজ কর্মস্থল পায়রা রিভারব্রিজ প্রজেক্ট এলাকায় ছিলেন। এ ঘটনায় করা মামলায় আগামীকাল রোববার রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। 

নিহত ছাত্রের বাবা আইনজীবী নাজমুল হক পটুয়াখালী থানায় করা মামলায় দাবি করেন, দুর্ঘটনার সময় জিপটি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-০৮০০) চালাচ্ছিলেন শহিদুল। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মোহন শিকদার ও মো. সোহেল। ঘটনার দিন সোয়া ৬টার সময় নাফিস বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে পায়রাকুঞ্জ ফেরিঘাটে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। গিলাবুনিয়া ইটবাড়িয়া মহিলা মাদ্রাসার সামনে মোটরসাইকেল রেখে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিল সে। এ সময় একটি জিপ বেপরোয়া গতিতে এসে নাফিস ও তার দুই বন্ধুকে চাপা দেয়। এর পর গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে যায়। গুরুতর অবস্থায় নাফিসকে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নাফিসের দুই বন্ধুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

তবে সমকালের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গাড়িটির চালক ছিলেন মো. জহির। ২০১৮ সাল থেকে মীর আক্তার হোসাইন লিমিটেডে কর্মরত তিনি। একই কোম্পানির পায়রা রিভারব্রিজ প্রজেক্টের ম্যানেজার হিসেবে পায়রায় কাজ করেন প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম। ঘটনার দিন তাঁর জিপে এক চায়নিজ নাগরিককে পটুয়াখালীতে নামাতে যান চালক জহির। তাঁকে নামিয়ে ফেরার সময় গাড়িতে ছিলেন কোম্পানির স্টোর সহকারী মো. রানা। আর পথে জিপে ওঠেন একই কোম্পানির ক্রেন অপারেটর মো. রিপন। দুর্ঘটনার পর থেকে মোবাইল বন্ধ রেখে গাড়িচালক গা-ঢাকা দিয়েছেন। তবে রিপন ও রানার সঙ্গে সমকালের কথা হয়।

ঘটনার বিবরণ দিয়ে রিপন জানান, একটি পার্সেল পাঠাতে তিনি পটুয়াখালীর চৌরাস্তার মোড়ে যান। ফেরার সময় রাস্তায় প্রজেক্ট ম্যানেজারের গাড়ি দেখে থামার সংকেত দেন। গাড়িচালক জহির পূর্বপরিচিত বলে তাঁকে তুলে নেন। গাড়ির পেছনে বসেন তিনি। আর সামনে ছিলেন স্টোর সহকারী রানা।

পটুয়াখালী-মির্জাগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের ২ নম্বর ব্রিজ সংলগ্ন সিকদার বাড়ির সামনে আসার পর একটি অটোরিকশা হঠাৎ যাত্রী ওঠাতে থামে। এর পর পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেল অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। এতে তিনজন ছিটকে জিপের ওপর পড়ে। দ্রুত চালকসহ জিপের তিনজন নেমে দেখেন, একজন রক্তাক্ত। অন্য দু’জন আহত। গুরুতর আহতকে ওই অটোরিকশায় তুলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলেন রিপন। তাঁকে তুলে দেওয়ার পরপরই আশপাশের লোকজন জড়ো হতে থাকে। জনতার মার খাওয়ার ভয়ে জহির গাড়ি নিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। রানা ও রিপন অন্য অটোরিকশায় উঠে চলে যান।

প্রত্যক্ষদর্শী রিপন সমকালকে বলেন, যে মোটসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়, তার পেছনে আরও দুটি মোটরসাইকেলে কয়েকজন ছিলেন। গুরুতর আহতদের গাড়িতে তোলার পর আশপাশের লোকজন দেখে ভয় পেয়ে যাই। চালক পালিয়ে যাওয়ার পর আমরা জনতার সঙ্গে মিশে যাই। এর পর চলে আসি। পরে শুনলাম, এই মামলায় শহিদুলসহ অন্য তিনজন আসামি। তারা কেউ গাড়িতে ছিলেন না। বিনা কারণে শহিদুল মারধরের শিকার হন। 

পায়রা রিভারব্রিজ প্রজেক্টের আরেক কর্মকর্তা কিশোর জানান, যখন ঘটনা শুনলাম, তখন কোম্পানির প্রজেক্ট ম্যানেজার শহিদুল অফিসে ছিলেন। প্রযুক্তিগত তদন্ত করলেই তা বেরিয়ে আসবে। ঘটনার দু’দিন পর পর পটুয়াখালীর শহরের গার্লস স্কুল রোডে তাঁর বাসা ঘেরাও করে অনেক লোক। তাঁকে বাসা থেকে বের করে বেদম মারধর করা হয়। বাঁচাতে গিয়ে সদর উপজেলার ইটবাড়িয়া ইউনিয়নের গিলাবুনিয়া এলাকার দিদ্দিক সিকদারের ছেলে মোহন সিকদার (৪১) ও একই এলাকার মৃত আতহার উদ্দিনের ছেলে মো. সোহেলকে (৪৫) মারধর করা হয়। প্রজেক্টে বালুর ব্যবসা করায় মোহনের সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় ছিল প্রকৌশলী শহিদুলের। এ কারণে বাসা ঘেরাও করার পর তিনি নিজেকে বাঁচাতে মোহনের সহযোগিতা চান।

নিহত শিক্ষার্থী নেয়ামুল হক নাফিসের বাবা নাজমুল হক বলেন, ‘আমার ছেলেসহ তাঁর তিন বন্ধুকে পায়রাকুঞ্জ ব্রিজ প্রকল্পের পিডি শহিদুল ইসলাম নিজেই মোটরসাইকেল চাপা দিয়েছেন। এ সময় তিনি বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন এবং নেশাগ্রস্ত ছিলেন। বিষয়টি সোমবার দুপুরের দিকে নিশ্চিত হই। এ সময় মোহন ও সোহেল আমার বাসায় এসে অসংগত কথাবার্তা বলতে থাকেন। এতে আমাদের সন্দেহ হলে তাঁকে আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা একপর্যায়ে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। বিষয়টি সদর থানার ওসিকে জানালে তিনি শহিদুলকে গ্রেপ্তারের জন্য কয়েক প্লাটুন পুলিশ পাঠান। এ সময় শত শত বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী শহিদুলের বাসা ঘিরে রাখেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খান। পরে সেনাবাহিনীকে অবহিত করলে তারা গিয়ে শহিদুলকে গ্রেপ্তার করে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে বাসা থেকে বের করে নেয়। এর পর পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।’

পটুয়াখালী সদর থানার ওসি ইমতিয়াজ মাহমুদ জানান, এ ঘটনায় শহিদুল ইসলামসহ তিনজনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার তিনজনকেই আদালতের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করা হবে। মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের হেলমেট ছিল কিনা, তা যাচাইয়ের কাজ চলছে। চালকের লাইসেন্স ছিল না কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হবে।  

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন পটুয়াখালী প্রতিনিধি)

আরও পড়ুন

×