ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

ভূরাজনীতির ভারসাম্য রক্ষার সঙ্গে গুরুত্ব পাবে দেশের স্বার্থ

ভূরাজনীতির ভারসাম্য রক্ষার সঙ্গে গুরুত্ব পাবে দেশের স্বার্থ

.

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:২৪ | আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৮:৪৪

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল একপেশে। ভারতের স্বার্থ রক্ষা করাই যেন ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এবার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জে নেমেছে ঢাকা। দেশের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি আঞ্চলিক স্বার্থ ও স্থিতিশীলতা রক্ষার বিষয়টি সামনে রেখে এগোচ্ছে সরকার।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের চীন সফরে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর পাশাপাশি গুরুত্ব পাবে আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষার কৌশল। আগামী ২১ জানুয়ারি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক হবে। বৈঠকে অংশ নেওয়া ছাড়াও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বেইজিং ও সাংহাইয়ের দুটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা করবেন। এ ছাড়া দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।

৫ আগস্ট সরকার পতনের পরপরই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিতে একত্রে কাজ করার কথা ব্যক্ত করেছে বেইজিং। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর আমন্ত্রণে ২০ জানুয়ারি বেইজিং যাচ্ছেন তৌহিদ হোসেন। সফরটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে ঢাকা।

গত সপ্তাহে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার চীন সফর উপলক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের নেতৃত্বে প্রায় ২৫টি মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও বিভাগের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

উপদেষ্টার চীন সফর নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের জন্য চীন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি তাদের কাছেও আমরা গুরুত্বপূর্ণ। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করে সফরে বৈঠকের আলোচ্য বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা হবে।

সূত্র জানায়, এটি যেহেতু চীনে উপদেষ্টার প্রথম সফর, এতে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির পাশাপাশি গুরুত্ব পাবে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক কৌশল। রাজনৈতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে ঢাকা ও দিল্লির যে দূরত্বের কারণে বিভিন্ন বিষয়ে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা বেইজিং দিয়ে কাটাবে বাংলাদেশ। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও সতর্ক থাকবে, যাতে প্রতিবেশীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। আর যেহেতু প্রথম বৈঠক, ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া এবং আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক কৌশল প্রাধান্য পাবে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা একটি বড় বিষয়।

২০২৪ সালে ৭ জানুয়ারির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে সর্বপ্রথম চীন প্রধানমন্ত্রীকে বেইজিং সফরের আমন্ত্রণ জানায়। তবে দিল্লি না গিয়ে বেইজিং সফর করতে চাননি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ভারতের সাধারণ নির্বাচন থাকায় সময়সূচি মেলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে ঢাকা ও দিল্লিকে। ফলে বেইজিং সফরের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হতেও দেরি হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত জুন মাসেই শেখ হাসিনা দু’বার দিল্লি সফর করেন। প্রথমবার নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে, দ্বিতীয়বার দ্বিপক্ষীয় সফরে। এর পর জুলাই মাসে বেইজিংয়ে দ্বিপক্ষীয় সফরে যান সরকারপ্রধান। সেখানে প্রত্যাশা অনুযায়ী আতিথেয়তা না পাওয়ায় সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা।

ফলে জুলাইয়ের আন্দোলনে ভারত হাসিনা সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের কথা বললেও চীন হেঁটেছে ভিন্ন পথে। কূটনৈতিক ব্রিফিংগুলোতে ঢাকার চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে, এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশে থাকা চীনের নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়টিতে জোর দেন তিনি। আর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই বেইজিং কাজ করার আগ্রহের কথা জানায়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিনিয়োগ নিয়ে আসে চীন। শুরুর ধাক্কা সামলাতে তাদের সহযোগিতা রয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়া চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা চারদিক থেকে বেইজিংকে কোণঠাসা করার চেষ্টায় রয়েছে। ফলে আসন্ন বৈঠকে ঢাকা বেইজিং থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাবে বলে আশাবাদী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সূত্র জানায়, আসন্ন বৈঠকে ভূরাজনীতির পাশাপাশি চীনের পক্ষ থেকে বৈঠকে বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশকে যুক্ত করার বিষয়টি জোর দিয়ে তোলা হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সুদের হার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসার পাশাপাশি ঋণের প্রতিশ্রুতি ফি দশমিক ৫ শতাংশ বাতিল চাওয়া হবে। এ ছাড়া বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। বিশেষ করে যে প্রকল্পগুলোতে বর্তমানে অর্থায়ন বন্ধ রয়েছে। এর বাইরে রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়াও চীনা বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য গুরুত্ব পাবে দুই দেশের শীর্ষ কূটনীতিক পর্যায়ের আলোচনায়।

ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের কাছে উপদেষ্টার আসন্ন বৈঠকে কোন কোন বিষয় গুরুত্ব পাবে– জানতে চাইলে দূতাবাস থেকে লিখিত উত্তরে বলা হয়, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সফরটি ২০২৫ সালে দুই দেশের প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সফর এবং দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। সফরটি দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য উল্লেখযোগ্য। বৈঠকে দুই পক্ষই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, রাজনৈতিক সহযোগিতা, সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির যৌথ উদযাপন, দুই দেশের জনগণ পর্যায়ে বছরজুড়ে সফর এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে আলোচনা হবে।

উপদেষ্টার চীন সফর নিয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেখা যাবে এবারের সফরে। অতীতে রাজনৈতিক সরকারগুলো চীন বা ভারত ভারসাম্যের চিন্তা করত। বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি অনেক বেশি স্বাধীন এবং এখানে বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সরাসরি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র জড়িত। এ জায়গায় উপদেষ্টার চীন সফরে জাতীয় স্বার্থ বেশি বিবেচিত হবে অন্য যে কোনো বিষয়ের চেয়ে। পররাষ্ট্রনীতিতে এখন যে একটি ধারা শুরু হলো ‘বাংলাদেশ প্রথম’ নীতি, এটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সামনের দিনের রাজনৈতিক সরকারগুলো কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে, সেটি দেখার বিষয়।

বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশের যুক্ত হওয়া নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান ভূকৌশল, ভূরাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতি; এ তিনটিকে বিবেচনায় রেখে জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আরও পড়ুন

×