ঢাকা শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

ঐক্যের কথা বলে বিভক্ত অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো

ঐক্যের কথা বলে বিভক্ত অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো

.

রাজীব আহাম্মদ

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫ | ০১:৩৯ | আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৫ | ১১:০৬

শেখ হাসিনার পতন ঘটানো অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো ঐক্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও, বিভেদে জড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির মতবিরোধ প্রকাশ্যে। দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বেড়েছে তিক্ততা। সব ইস্যুতেই ছাত্র নেতৃত্বের বিপরীতে অবস্থান বিএনপির। ছাত্র নেতৃত্বের সংগঠনগুলোতে দ্বন্দ্ব জামায়াতের প্রভাবে।

সরকার, দল ও সংগঠনগুলোর নেতাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তাদের ভাষ্য, অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নিয়ে শুরু বিভেদ। নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে তা বিভক্তিতে রূপ নেয়। আগস্টে রাজনৈতিক দল ও ছাত্র নেতৃত্ব সংস্কারে সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও, দ্রুত নির্বাচন চায় বিএনপি। তবে সংস্কারে জোর জামায়াত ও ছাত্র নেতৃত্বের। তাদের ভাষ্য, বিএনপি ক্ষমতায় বসলে অভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার করবে না।

সরকার চলতি বছরের শেষ থেকে আগামী বছরের প্রথমার্ধকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেছে। এতে সন্দিহান বিএনপি ছাত্র নেতৃত্বের দল গঠনের উদ্যোগকে সরকারি সমর্থনের ফল এবং তাদের ক্ষমতার বাইরে রাখার চেষ্টা হিসেবে দেখছে। রাজনীতির মেরূকরণে অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে চড়াও হয়েছে। জামায়াতকে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য বিদ্ধ করছে বিএনপি। আওয়ামী লীগ না থাকায় রাজনীতির মাঠে দু’দল এখন প্রতিদ্বন্দ্বী।

ছাত্র নেতৃত্ব একাত্তর মুছে চব্বিশের অভ্যুত্থানকে গৌরবান্বিত করছে অভিযোগ বিএনপির। জামায়াত ও ছাত্র নেতৃত্ব বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তুলনা করে চাঁদাবাজি-দখলদারিত্বের দায় দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার ছাড়াও সংঘর্ষে জড়িয়েছে। বরিশালে বিজয় মিছিলে হামলার জন্য বিএনপিকে দায়ী করেছে নাগরিক কমিটি। চট্টগ্রাম, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।

গত ৪ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাদের বৈঠকে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি পালনের কথা হলেও দেখা যায়নি। পারস্পরিক অবিশ্বাসের কথা বলেছেন খোদ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘হাসিনার পালানোর পর থেকে আমরা কেন জানি নিজেদের পুরো বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারছি না, ঐক্যের জায়গায় থাকতে পারছি না। এখন একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য।’ গতকাল শনিবারও বিএনপি মহাসচিব বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশেরই কিছু মানুষ ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে।

কৃতিত্ব নিয়ে বিরোধ
আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিএনপি-জামায়াত দমন-পীড়নের শিকার হয়। তারা বারবার আন্দোলনেও সরকার পতনে সফল হতে পারেনি। অন্যদের নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করেও ঠেকাতে পারেনি গত বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন। তাতে শেখ হাসিনার আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিতই মনে করা হচ্ছিল। তবে সব উল্টে যায় আদালতের রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্তে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাইয়ের প্রথম দিন থকে আন্দোলন শুরু করে, যাতে ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ হামলা চালালে সূত্রপাত হয় অভ্যুত্থানের। পরের দিন পুলিশের বন্দুকের সামনে রংপুরে বুক পেতে দাঁড়ানো আবু সাঈদ নিহতে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় সারাদেশে। সাধারণ মানুষ পথে নেমে আসে। ১৮ থেকে ২১ জুলাই চলে আওয়ামী লীগের সহায়তায় পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ।

সে সময় সাধারণ মানুষ ও ছাত্রদের পাশে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী থাকলেও, দল দুটি তা প্রকাশ্যে আনেনি। ব্যাপক ধরপাকড়ের শিকার হলেও, একই কৌশল বজায় রাখে ৪ আগস্ট পর্যন্ত। পরের দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে পতন ঘটে শেখ হাসিনার। বিএনপি-জামায়াত উভয়ে এখন বলছে, অভ্যুত্থানকে রাজনৈতিক তকমা দিয়ে যেন শেখ হাসিনা অতীতের মতো দমন করতে না পারেন, সে কারণে এমন কৌশল ছিল তাদের।

কার্যত অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব এখন সবাই দাবি করছে। বিএনপির ভাষ্য, তাদের নেতাকর্মী সবচেয়ে বেশি জীবন দিয়েছেন। আন্দোলন চলাকালে নিষিদ্ধ হওয়া জামায়াত-শিবির সংখ্যা বলেনি। তবে ছাত্রশিবিরের ভাষ্য, অভ্যুত্থান এগিয়েছে তাদের পরিকল্পনায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শিবিরকে সহযোদ্ধা বললেও, ছাত্রদলের সঙ্গে ক্যাম্পাসগুলোতে বিরোধে জড়াচ্ছে। ছাত্রনেতৃত্ব বিএনপির সাড়ে ১৫ বছরের ব্যর্থতাকে তুলে ধরে অভ্যুত্থানকে নিজেদের দাবি করছে।

রাষ্ট্রপতি অপসারণ প্রশ্নে বিভেদ প্রকাশ্যে
ছাত্র নেতৃত্বের সঙ্গে বিএনপির বিরোধ প্রকাশ্য হয় রাষ্ট্রপতির অপসারণ প্রশ্নে। অক্টোবরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি শেখ হাসিনার মনোনীত মোঃ সাহাবুদ্দিনকে অপসারণে আলটিমেটাম দেয়। অন্যান্য দল শর্তসাপেক্ষে সমর্থন দিলেও, সাংবিধানিক সংকটের কারণ দেখিয়ে বিরোধিতা করে বিএনপি। সরকারও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসে। এর পর বিএনপি ও ছাত্রনেতৃত্বকে আর এক টেবিলে দেখা যায়নি।

ছাত্র নেতৃত্ব সংবিধান বাতিল এবং দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র তথা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দেওয়ার দাবি তুলেছিল। ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনার থেকে ঘোষণাপত্র পাঠের কথা জানানো হয়। কিন্তু সংবিধান বদলের বিরোধী বিএনপির বাধায় তা হয়নি। ৩০ ডিসেম্বর  সরকার জানায়, তারাই দেবে ঘোষণাপত্র।

অনৈক্যের কথা স্বীকার করে নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন সমকালকে বলেন, ‘অভ্যুত্থানের অর্জন কুক্ষিগত করার প্রবণতা রয়েছে। ছাত্ররা প্রথমে তা ধরতে পারেনি। দূরদর্শিতারও অভাব রয়েছে। যা হয়েছে, তাতে আমরা দুঃখিত, মর্মাহত। শহীদের সংখ্যা বলে কেউ কৃতিত্ব নিলেও শহীদের দায় কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। তাই শহীদদের স্বপ্ন পূরণের বাধ্যবাধকতা ছাত্র নেতৃত্বের রয়েছে।’

স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে সবার বিপরীতে বিএনপি
রাষ্ট্রপতি অপসারণ, সংবিধান এবং ঘোষণাপত্র ইস্যুতে বিএনপির আপত্তি মানলেও সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চায় সরকার। সায় আছে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া কয়েকটি দলের। একই অবস্থান নাগরিক কমিটির। কিন্তু বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে তৃণমূলের ভোট চায় না।

উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে স্থানীয় সরকার (ইউপি) নির্বাচনের কথা বলেছেন। দলীয় প্রতীকবিহীন এসব নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের আপত্তির সুযোগ কোথায়? স্বাধীন ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ছাড়া একদলীয় শাসন থেকে মুক্তির উপায় আছে কি?

নাগরিক কমিটির একাধিক নেতা সমকালকে বলেছেন, রাষ্ট্রপতি, সংবিধান ও ঘোষণাপত্র প্রশ্নে বিএনপি বড় ধাক্কা দিয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান মানতে হলে ছাত্র নেতৃত্ব দল হিসেবে দাঁড়াতে পারবে না। সংগঠনটির সংশ্লিষ্টরা জনপ্রতিনিধিশূন্য স্থানীয় সরকারে রাজনৈতিক প্রশাসক নিয়োগে চিঠিও দিয়েছে। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার নেতৃত্বে এ বিষয়ে কাজও চলছে।

শক্তিগুলোর মধ্যে তিক্ততা
জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান তাঁর দল ও সেনাবাহিনীকে পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক আখ্যা দেন। এ বক্তব্যের সমালোচনা করে জামায়াতকে রগকাটা, ব্যাংক দখলকারী ও মোনাফেক বলেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। পরে বিবৃতি দিয়ে জামায়াত ২০১৮ সালে ভিন্ন মতের সঙ্গে জোট গড়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপির ঐক্যকে জাতির সঙ্গে মোনাফেকি আখ্যা দেয়। এর পর ভেরিফায়েড ফেসবুকে বিএনপি প্রশ্ন রাখে, ‘সেই নির্বাচনে শফিকুর রহমান নিজেও ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছিলেন। তাহলে কার সঙ্গে জোট? কার সঙ্গে মোনাফেকির কথা বললেন?’

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, ‘যে লক্ষ্যে অভ্যুত্থান, তা পূরণে ঐক্য জরুরি। কিছু কথা ও কাজ হচ্ছে, যা ঐক্যের পরিপন্থি।’ অভ্যুত্থানের ঐক্য কেন টিকল না– প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ঐক্যের জন্য দল, গোষ্ঠী ও ধর্মীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হয়। স্বার্থরক্ষার চেষ্টায় ঐক্য নষ্ট হচ্ছে। সংস্কার নয়, ক্ষমতা দরকার মনোভাব থাকলে ঐক্য ব্যাহত হবেই।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘জামায়াতের কর্মকাণ্ড ও কিছু বক্তব্যে বিএনপি মনোক্ষুণ্ন। তবে তাদের সঙ্গে এমন কোনো দূরত্ব নেই। তারা  গণতন্ত্র ও নির্বাচন চায়, মানুষের অধিকারের কথা বলে। আমরাও বলি। কিন্তু কেউ যদি বলে তারাই শুধু দেশপ্রেমিক, তাহলে আমাদের কষ্ট লাগবেই।’

সংস্কার প্রশ্নে জামায়াতের হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, ‘ঐক্য হোক বা না হোক সংস্কার জরুরি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না ফিরিয়ে নির্বাচন হলে দেশ আগের অবস্থায় ফিরবে। সংবিধানের সংস্কার লাগবেই।’ সামান্তা শারমিন বলেন, ‘ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর হয় না সংবিধানের কারণেই। সংবিধানে বদল না হলে আবার সেই ব্যবস্থা ফিরবে।’ যদিও বিএনপি মহাসচিব আগেই বলেছেন, নির্বাচিত সংসদ ছাড়া সংবিধানের সংস্কার বৈধতা পাবে না।

ছাত্র নেতৃত্বের দল নিয়ে সন্দেহে বিএনপি
সরকারি পৃষ্ঠপোষকে রাজনৈতিক দল গঠনের অভিযোগ নাকচ করে সামান্তা শারমিন বলেন, ‘আগে দেখতে হবে ক্ষমতায় আছে কিনা।’ বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘আসলে ক্ষমতায় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় কারা আছে, তা দেখতে হবে।’

নাগরিক কমিটির সূত্র জানিয়েছে, সরকার নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণার পর বিএনপি ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে ধরে নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসন তাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ছাত্র নেতৃত্ব সরকারি সহযোগিতা দূরে থাক, অসহযোগিতায় পাচ্ছে।

এদিকে নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জামায়াতের প্রভাবের কারণে উপদল তৈরি হচ্ছে বলে একাধিক নেতা জানিয়েছেন। এক নেতা সমকালকে বলেন, ছাত্রশিবিরের প্রতি সহানুভূতিশীলরা নিজেদের মতো কাজ করতে চাইছেন। এতে দল গঠন বিঘ্নিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন

×