ঢাকা শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

স্থূলতা প্রতিরোধে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

স্থূলতা প্রতিরোধে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ে মঙ্গলবার ‘বাংলাদেশে দৈহিক স্থূলতার ব্যাপকতা: সচেতনতা, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত অতিথিরা- সমকাল

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০১:২৩ | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০৮:৪৭

স্থূলতা বা ওবেসিটি দেশের তরুণ সমাজের জন্য বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে এ রোগ। স্থূলতার কারণে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ অসংক্রামক নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। কেবল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করলেই এ সংকট নিরসন সম্ভব। পাশাপাশি স্থূলতা প্রতিরোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা।

বিশ্ব স্থূলতা দিবস ২০২৫ উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার সমকাল কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশে দৈহিক স্থূলতার ব্যাপকতা: সচেতনতা, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের শীর্ষস্থানীয় এন্ডোক্রাইনোলজি বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন। বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইনোলজি সোসাইটি, এসিআই লিমিটেড ও সমকাল যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে দেশে স্থূলতা পরিস্থিতি বিশ্লেষণের পাশাপাশি প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে মতামত তুলে ধরা হয়। 

সমকালের অনলাইন ইনচার্জ গৌতম মণ্ডলের সঞ্চালনায় বৈঠকে বক্তব্য দেন বারডেম হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের পরিচালক এবং বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান, বারডেম হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সহসভাপতি ডা. ফিরোজ আমিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও এন্ডোক্রাইন সোসাইটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ডা. তাহনিয়াহ্ হক, বিএসএমএমইউর এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও এন্ডোক্রাইন সোসাইটির আজীবন সদস্য ডা. সামিরা মেহজাবিন, বিএসএমএমইউর এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও এন্ডোক্রাইন সোসাইটির যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. মারুফা মোস্তারী, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও এন্ডোক্রাইন সোসাইটির নির্বাচিত সভাপতি ডা. ফারিয়া আফসানা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও এন্ডোক্রাইন সোসাইটির গবেষণা সম্পাদক ডা. এম সাইফুদ্দিন, ইউনাইটেড হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান, বিএসএমএমইউর এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহজাদা সেলিম, এসিআই হেলথকেয়ার লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও চিফ অপারেটিং অফিসার এম মহিবুজ জামান এবং এসিআই লিমিটেডের ডিরেক্টর মার্কেটিং অপারেশনস মো. মুহসিন মিয়া।

বৈঠকে অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান বলেন, ‘স্থূলতার কারণে সৃষ্ট নানা জটিলতায় বছরে বিশ্বে ৪০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্বজুড়েই প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে স্থূলতার হার বাড়ছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে ৮০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ স্থূলতায় আক্রান্ত। ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ অতিরিক্ত ওজনধারী এবং ১৩ শতাংশ স্থূলতায় ভুগছে। মূলত ফাস্টফুড ও উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারার কারণে স্থূলতা বাড়ছে। স্বাস্থ্যকর জীবনধারার মাধ্যমেই এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হবে।’ 

অধ্যপক ডা. ফিরোজ আমিন বলেন, ‘অতিরিক্ত ওজন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এ উপমহাদেশের মানুষের বডি ম্যাস ইনডেক্স (বিএমআই) সূচক যদি ২৩ অথবা তার বেশি হয়, সেটিকে অতিরিক্ত ওজন ধরা হয়। আর ফলাফল যদি ৩০ অথবা তার বেশি হয়, তখন সেটিকে বলা হয় স্থূলতা।’ অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনকে স্থূলতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা কতক্ষণ ব্যায়াম করি, হাঁটি, কী খাবার খাই– এসব নিয়ে ভাবতে হবে।’ 
ডা. তাহনিয়াহ্‌ হক বলেন, ‘এশিয়ার মানুষের জীবনধারা আমেরিকা-ইউরোপের মানুষের জীবনধারা থেকে আলাদা। স্থূলতায় আক্রান্তদের পরামর্শ দেওয়ার সময় এটি বিবেচনায় রাখা জরুরি। আমাদের দেশের মানুষ উচ্চ কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার গ্রহণ করে বেশি, পক্ষান্তরে হাঁটাচলা করে কম। তাই স্থূলতা একটি সাধারণ রোগ হয়ে উঠেছে, যা উপেক্ষা করার মতো নয়।’

ডা. সামিরা মেহজাবিন বলেন, ‘স্থূলতা শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমের ওপর প্রভাব ফেলে এবং একাধিক জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এর মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস। স্থূলতা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়িয়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের প্রধান ঝুঁকি তৈরি করে। অতিরিক্ত ফ্যাট কোষ ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। ফলে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। প্যানক্রিয়াসের বিটা সেলের কার্যকারিতা কমে ইনসুলিন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়। দ্বিতীয় যে রোগটি হয় তা হৃদরোগ। অতিরিক্ত ওজন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের রক্তনালির ব্লকেজ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।’

ডা. মারুফা মোস্তারী বলেন, ‘স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে হয়, যার মধ্যে রয়েছে খাদ্যাভ্যাস।’ নিয়মিত ব্যায়াম করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘জনগণকে স্থূলতা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। সুষম খাবার গ্রহণের পাশাপাশি যথেষ্ট পরিমাণ পানি পান করতে হবে।’

ডা. ফারিয়া আফসানা বলেন, ‘স্থূলতা প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চারটি অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে কাজ করে। স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত শরীরচর্চা, ফাস্টফুড পরিহার এবং চিনিযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা। বাংলাদেশেও স্থূলতা প্রতিরোধে তিনটি লক্ষ্য অর্জনে সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রম চলমান।’
ডা. এম সাইফুদ্দিন বলেন, ‘স্থূলতা নিয়ে সমাজে নানা কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস রয়েছে। প্রথম অন্ধবিশ্বাস হলো, স্থূলতার জন্য ব্যক্তি নিজেই দায়ী। কিন্তু নানা কারণে স্থূলতা দেখা দিতে পারে। জিনগত কারণেও স্থূলতা হয়। অনেকের ধারণা, স্থূল ব্যক্তিরা অলস। তাদের দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে না। বাস্তবে অনেক স্থূল ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। আবার অনেকে মনে করেন, স্থূল মানুষের জীবনযাত্রা অস্বাস্থ্যকর। বাস্তবে সেটি সঠিক নয়।’

অধ্যাপক ডা. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘স্থূলতা একটি ক্রনিক ডিজিজ। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই এটি শনাক্ত করা সম্ভব। কারও স্থূলতা হয়ে গেলে প্রথমে দেখতে হবে, কী কারণে তা দেখা দিল। স্থূলতায় ভোগা ব্যক্তি ধূমপানে আসক্ত কিনা, সেটিও দেখতে হবে। এ ছাড়া কিছু রুটিন পরীক্ষা করা হয়। যেমন রক্তে সুগার ঠিক আছে কিনা; তার ডায়াবেটিস, ফ্যাটিলিভার, রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ, পিত্তথলিতে পাথর আছে কিনা ইত্যাদি।’ মেয়েদের পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম আছে কিনা, সেটিও দেখা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি শর্করা খাই আমরা। আর আমিষ জাতীয় খাবার খাই সর্বনিম্ন। দেশের মানুষ এখনও আলুকে সবজি মনে করে। এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘কোন খাবার স্বাস্থ্যকর, সে বিষয়ে আমাদের গবেষণা কম, তাই জ্ঞান সীমিত।’ যেসব গবেষণা আমাদের সামনে, তার অধিকাংশই অন্য দেশ বা সংস্থার বলে উল্লেখ করেন তিনি।

স্থূলতা প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, মন্তব্য করে এম মহিবুজ জামান বলেন, ‘স্থূলতা দুইভাবে প্রতিরোধ করা যায়। একটি হলো, স্থূলতা যাতে না হয় সে জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, অন্যটি জীবনধারা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধের প্রয়োজন হয়, যেমন টিরজেপ।’ এই ওষুধ এসিআই ফার্মা বাজারে এনেছে এবং তা বিশ্বমানের বলে উল্লেখ করেন তিনি।

মো. মুহসিন মিয়া বলেন, ‘স্থূলতা প্রতিরোধে চিকিৎসকদেরও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শুধু জীবনযাপন পরিবর্তন করে স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এখানে ওষুধের প্রয়োজন রয়েছে। গবেষণাক্ষেত্রে ফার্মা কোম্পানিগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে এসিআই দেশের এন্ডোক্রাইনোলজিস্টদের সহযোগিতায় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে। তবে চিকিৎসক এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোর আরও সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।’

আরও পড়ুন

×