অপরাধ দমনে কঠোর বার্তা, দল-মত না দেখার নির্দেশ

কোলাজ
সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৫ | ০১:১১ | আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৫ | ০৯:৩৩
অপরাধ দমনে পুলিশের মাঠ প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে কঠোর বার্তা। দল বেঁধে সহিংসতাসহ (মব ভায়োলেন্স) যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এখন থেকে আরও শক্তভাবে মোকাবিলা করতে বলা হয়েছে। অপরাধে জড়ালে দল-মত, গোষ্ঠী দেখা হবে না। কেউ আইন হাতে তুলে নিলেই নেওয়া হবে ব্যবস্থা।
গতকাল রোববার ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করে আইজিপি বাহারুল আলম এই বার্তা দেন। অপরাধের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে সব রেঞ্জ ডিআইজি ও মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে করণীয় ও আগামীর চ্যালেঞ্জও উঠে আসে আলোচনায়। বৈঠকে অংশ নিয়েছেন এমন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বৈঠকে ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা জানান, পুলিশের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে কড়া বার্তা দেওয়া হয়। কারও মুখ দেখে আইন প্রয়োগ করা যাবে না। এ ছাড়া সমন্বয়কসহ অন্য কোনো প্রভাবশালী পরিচয়ে বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়ালে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। আইন প্রয়োগ করতে পুলিশের কেউ হামলার শিকার হলে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। পুলিশ মহাপরিদর্শক মাঠ পর্যায়ের পুলিশ প্রশাসনকে বলেছেন– কেউ অপরাধে জড়ালে তার প্রতি মানবিক আচরণ করা যাবে না। এ ছাড়া সচেতনভাবে দায়িত্ব পালনের পরামর্শ দেওয়া হয়। অহেতুক ত্রুটি–বিচ্যুতিতে না জড়াতেও বলা হয়েছে।
একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগে গ্রেপ্তার বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সহকারী বুকবাইন্ডার মোস্তফা আসিফ অর্ণবের বিষয়টি আলোচনায় আসে। তাকে গ্রেপ্তারের পর ‘তৌহিদি জনতার’ ব্যানারে একদল লোক রাতেই থানায় যায়। পুলিশের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বলা হয়– সুনির্দিষ্ট অভিযোগে কাউকে গ্রেপ্তারের পর কোনো পক্ষ মব তৈরি করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে মব ভায়োলেন্স করে একটি শ্রেণি বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের ওপর একের পর এক আক্রমণ করে যাচ্ছে। পুলিশ হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে আসামি। আবার অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার পর তাদের ছাড়িয়ে নিতে থানা ঘেরাও করার মতো ঘটনাও ঘটছে। যাত্রাবাড়ীর জনপথ মোড়ে দায়িত্ব পালনকালে আশ্রাফ আলী নামে এক পুলিশ সদস্যকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অটোরিকশা চালকদের মূল সড়ক থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করলে পুলিশের ওপর আক্রমণ করা হয়। এতে শিক্ষানবিশ সার্জেন্ট আমিরুল ইসলাম গুরুতর জখম হন। নরসিংদীতে ডাকাতি মামলার আসামি ছাড়িয়ে নিতে থানায় হামলা করা হয়। সরকারি পিকআপ ভ্যান দা দিয়ে কোপানো হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে এসআই তারেক আহমেদ সহকর্মীদের নিয়ে মনিরুল ইসলাম নামে এক আসামিকে গ্রেপ্তার করার পর শতাধিক লোক আসামি ছিনিয়ে নিতে পুলিশকে বাধা দেয়। এর পর পুলিশকে মারধর ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাঙচুর করে আসামি ছিনিয়ে নেয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আভিযানিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে পুলিশ এভাবে আক্রমণের শিকার হলে সমাজে ভুল বার্তা যায়। আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যাবে। এর সুযোগ নেয় অপরাধীরা। এখন থেকে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যারা জড়াবে, তাদের ব্যাপারে নেওয়া হবে কঠোর পদক্ষেপ। কেউ আইন হাতে তুলে নিলে জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ করা হবে। অপরাধীদের ধরন বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
ভার্চুয়াল বৈঠকে উপস্থিত পুলিশের আরেক কর্মকর্তা জানান, রোজায় ছিনতাই-ডাকাতিসহ অপরাধের ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথা বলা হয়। ঈদের আগে কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর টাকা স্থানান্তর করা হলে পুলিশ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। আরেক কর্মকর্তা জানান, হিযবুত তাহ্রীরের কর্মকাণ্ডের ওপর বিশেষ দৃষ্টি রাখতে নির্দেশ দেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ধর্ষণসহ সব ধরনের নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা বলা হয়। এখন পর্যন্ত নারী নিপীড়নের যত সহিংসতা হয়েছে, সেগুলোর তালিকা করে দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ‘ছিনতাইকারী’ বলে মব সৃষ্টি করে দুই ইরানি নাগরিকসহ তিনজনকে বেদম মারধর করা হয়। ‘মব’ তৈরি করে গুলশানে সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর বাসায় ঢুকে তল্লাশির নামে মালপত্র তছনছ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। গাজীপুরে যাত্রীবাসকে সাইড দেওয়া নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার জেরে রিটন মিয়া নামে এক অটোরিকশাচালককে হাত ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়। টাঙ্গাইলে ছাত্র প্রতিনিধি পরিচয়ে আওয়ামী লীগ নেতার ছয় তলা বাড়ি দখল করে ভবঘুরেদের আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়। পরে তা মুক্ত করে প্রশাসন।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়– ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনা ২০১টি। এতে নিহত ১৭৯ ও আহত ৮৮। ২০২৩ সালে ঘটনা ১২৪, নিহত ৭৩ ও আহত ৯১। এই হিসাবে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। ২০২২ সালে ৭৯ ঘটনায় নিহত ৩৮ ও আহত ৮৩। ২০২১ সালে ৮৩ ঘটনায় নিহত ৪৮ ও আহত ৮৫। এ ছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে গণপিটুনিতে মারা গেছে ১৬ ও ফেব্রুয়ারিতে ১১ জন।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, মাগুরার ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আবার মব ভায়োলেন্স হচ্ছে। পুলিশকে শক্তভাবে এসব মোকাবিলা করতে হবে। শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা কাজে দেয়। পুলিশের চাকরির ধরনই এমন, যখন যে সমস্যা আসবে তা সামনে থেকে মোকাবিলা করতে হয়।
পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়শনের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আনিসুজ্জামান সমকালকে বলেন, বাস্তবতার নিরিখে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক। এতে বাহিনীর মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা উজ্জীবিত হবেন। জনগণের সেবক হয়ে আমরা কাজ করতে চাই। তবে শত্রু ভেবে জনগণ যদি পুলিশকে আঘাত করে, তাহলে ক্ষতি তাদেরই। কেউ যদি ইউনিফর্মধারী সদস্যদের নাজেহাল ও যৌন হয়রানি করেন, এটা আইনের শাসনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
আরেক জেলার পুলিশ সুপার বলেন, অনেক দিন পর এই ধরনের কঠোর বার্তা পুলিশকে চাঙ্গা করবে। আইন প্রয়োগ করতে গেলেও পুলিশ যে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে, সেটা কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পারবে। অপরাধীদের কাছেও নতুন বার্তা যাবে।
- বিষয় :
- অপরাধ