সামাজিক সুরক্ষায় যুক্ত হচ্ছে ১০ লাখ নতুন উপকারভোগী

.
মেসবাহুল হক
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৫ | ০১:২৫ | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৫ | ০৮:২৭
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় যুক্ত হচ্ছে নতুন প্রায় ১০ লাখ উপকারভোগী। কয়েকটি কর্মসূচিতে ভাতা বাড়ানো হবে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে স্বস্তি দিতে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এ উদ্যোগ থাকছে। এতে সরকারের বাড়তি ব্যয় হবে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। জাতীয় বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের চারটি ও খাদ্য অধিদপ্তরের একটি কর্মসূচিতে অন্তত ১০ লাখ উপকারভোগী বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
সূত্রটি জানায়, প্রতি মাসে ৬০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন ৬০ লাখ উপকারভোগী। আগামী বাজেটে ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে ৬১ লাখ করা হচ্ছে। ভাতার পরিমাণ করা হবে ৬৫০ টাকা। এ ছাড়া বিধবা ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৭ লাখ ৭৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৯ লাখে উন্নীত করা হচ্ছে। মাথাপিছু ভাতার পরিমাণ ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা করা হচ্ছে।
চলতি বাজেটে ৮৫০ টাকা করে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন ৩২ লাখ ৩৪ হাজার উপকারভোগী। নতুন বাজেটে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৪ লাখ করার পাশাপাশি ভাতা করা হচ্ছে ৯০০ টাকা। মা ও শিশু উপকার কর্মসূচিতে উপকারভোগীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৫৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১৭ লাখ ৭১ হাজার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ ৮০০ থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে ৮৫০ টাকা। এছাড়া খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা ৫০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫৫ লাখ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া হিজড়া, বেদে, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও চা শ্রমিকদের ভাতা ক্ষেত্র বিশেষে ১৫০ টাকা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এর আগের বছরগুলোতেও ভাতার পরিমাণ ও আওতা বাড়িয়েছিল সরকার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা বেড়েছিল ১০০ টাকা, আর বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতদের ভাতা ৫০ টাকা বাড়ানো হয়। অন্যদিকে, প্রতিবন্ধী ভাতা সবশেষ সমন্বয় করা হয় ২০২২-২৩ অর্থবছরে, ৭৫০ থেকে বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা করা হয়েছিল। একইসঙ্গে কিছু ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, জীবনযাপনের ব্যয় বিবেচনা করে দরিদ্র, অসহায় জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বস্তি দিতে নতুন বাজেটেও এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
অনেকদিন ধরে দেশের অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন, প্রকৃত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সরকারের বরাদ্দ অনেক কম। আবার এই কর্মসূচিতে সরকার অবসর সুবিধা, সঞ্চয়পত্রের সুদের মতো অর্থায়নকে যুক্ত করে বড় করে দেখাচ্ছে, যা দরিদ্র জনসংখ্যার সামাজিক নিরাপত্তায় প্রত্যক্ষ অবদান রাখে না।
তারা মনে করেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতির চাপসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য কারণে সমাজের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিয়মিত নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের নিরাপত্তা দিতে সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও অপচয় কমিয়ে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, বাজার পরিস্থিতি বা মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী ভাতার পরিমাণ কম। সরকারের রাজস্ব আয়ও কম। এ ক্ষেত্রে ব্যয় করার জন্য সরকারের সক্ষমতাও কম। এর মধ্যে সরকার ভাতা ও সুবিধাভোগী বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি ইতিবাচক। তবে ভাতার পরিমাণ আরও কিছুটা বাড়ানো গেলে ভালো হতো। তাছাড়া একটি কল্যাণমূলক দেশ গঠনে সর্বজনীন ন্যূনতম আয়ের নামে একটি সমন্বিত সুরক্ষা কর্মসূচির দিকে যেতে পারলে ভালো হয়।
ইউনিভার্সেল বেসিক ইনকাম (ইউবিআই) বা ‘সর্বজনীন ন্যূনতম আয়’ নামে একটি সমন্বিত সুরক্ষা কর্মসূচির প্রস্তাব করে সিপিডি। এতে বলা হয়, নতুন এ পদ্ধতিতে দেশের প্রতিটি উপযোগী পরিবার জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম একটি আয় (অর্থ সহায়তা) রাষ্ট্র থেকে পাবে। আর এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা গেলে জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার ৬ দশমিক ১৩ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।
সিপিডি জানায়, দেশে দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বেড়েছে। ফলে দারিদ্র্য টেকসইভাবে কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। সে লক্ষ্যে ইউবিআই কর্মসূচি প্রস্তাব করা হয়েছে। সিপিডি হিসাব করে দেখেছে, সংশ্লিষ্ট পরিবারের আয়ের পাশাপাশি এদের মাসে ৪ হাজার ৫৪০ টাকা ন্যূনতম সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। এতে একটি পরিবার তার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে।
গত বুধবার অর্থ বিভাগের মাল্টিপারপাস হলরুমে আগামী বাজেট প্রণয়নের নীতিগত বিষয়ের ওপর ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় কিছু কর্মসূচিতে মাসিক ভাতা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, নতুন বাজেটের মূল উদ্দেশ্য সমতাভিত্তিক ও কল্যাণধর্মী। সার্বিকভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হবে। তবে সম্পদ সীমিত হওয়ায় ভাতার পরিমাণ কতটুকু বাড়ানো যায়, সেটা বিবেচনা করা হবে।
সামাজিক কর্মসূচি নিয়ে আরও যে সিদ্ধান্ত
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে আরও জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা উপবৃত্তি পাওয়া প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১৯ হাজার কমতে যাচ্ছে। বর্তমানে ১ লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি পায়। যাচাই করে দেখা গেছে, এদের মধ্যে ১৯ হাজার শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষা উপবৃত্তিও পায়। এ জন্য ওই সব শিক্ষার্থীকে প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
বেদে সন্তানদের শিক্ষা উপবৃত্তির সুবিধাভোগী বাড়ছে আগামী অর্থবছরে। বর্তমানে ৪ হাজার ৩৯৮ জন বেদে সন্তান শিক্ষা উপবৃত্তি পায়। আগামী অর্থবছরে এ সুবিধা পাবে ৪ হাজার ৮৩৮ জন। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সন্তানদের শিক্ষা উপবৃত্তির সুবিধাভোগী ২৮ হাজার ৯১২ জন থেকে বাড়িয়ে ৩১ হাজার ৯০২ জন করা হচ্ছে।
এ ছাড়া চা শ্রমিকদের এককালীনের পরিবর্তে মাসিক ভাতা দেওয়া হবে। এতদিন চা শ্রমিকদের বছরে একবার ৬ হাজার টাকা দেওয়া হতো। আগামী অর্থবছর থেকে প্রতি মাসে ৬৫০ টাকা করে দেওয়া হবে বলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। পাশাপাশি চা শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করতে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হবে।
বর্তমানে ২৬টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪০টি কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ জন্য চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যা জাতীয় বাজেটের ১৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।
- বিষয় :
- সামাজিক মাধ্যম