আজ ২৫ মার্চ: জাতীয় গণহত্যা দিবস
গণহত্যা ও নৃশংসতায় ভয়াবহ কালরাত

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। গুলিতে নিহত কয়েকজনের মরদেহ এভাবে পড়ে ছিল রিকশায় -সংগৃহীত
ডা. সারওয়ার আলী
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৫ | ০১:৩৪ | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৫ | ০৭:৩৯
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে কোনো নির্বাচন হয়নি। সত্তরে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু নির্বাচনের রায় উপেক্ষা করে গণহত্যার মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমাতে চেয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে যে গণহত্যা চালানো হয়, তা নিছক মানুষ হত্যা ছিল না; ছিল জেনোসাইড। জেনোসাইড শুধু ‘ম্যাস কিলিং’ বা ‘ব্যাপক হারে হত্যা’ নয়।
বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠী বা ধর্ম-বর্ণ ও বিশ্বাসের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত পন্থায় পরিচালিত ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, আক্রমণ ও পীড়ন, যা সেই জনগোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, সেটাই জেনোসাইড। যেহেতু বাঙালি তার স্বাধিকার সংগ্রামের এক পর্যায়ে অসহযোগ আন্দোলন করেছিল, সে কারণে তারা বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে।
২৫ মার্চে অপারেশন সার্চলাইট নামে তারা পরিকল্পিতভাবেই ‘জেনোসাইড’ সংঘটিত করে। এই জেনোসাইডের ব্যাপকতা ও নৃশংসতাও ছিল ব্যাপক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অল্প সময়ে এত ব্যাপক গণহত্যা কোথাও দেখা গিয়েছে বলে মনে হয় না। একে পরিকল্পিত গণহত্যা বলার কারণ হলো, বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে নির্বিচারে গণহত্যা হয়েছে।
এমন কোনো জেলা বা উপজেলা সদর নেই, যেখানে গণহত্যা চালানো হয়নি। গণহত্যার ক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়কেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। কারণ তাদের ধারণা ছিল, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এই স্বাধিকার আন্দোলনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তাদের ধারণা ছিল, যারা বুদ্ধিজীবী তথা শিল্পী-সাহিত্যিক, শিক্ষক, চিকিৎসকরাও এই স্বাধিকার আন্দোলনে প্রেরণা জোগাচ্ছে। সে জন্য তাদের চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে যে জেনোসাইড হয়েছে, তার পর বাংলাদেশে আমরা যদি একটি মানবিক সমাজ গড়তে চাই, তবে এমন অমানবিক, মানবতাবিরোধী এই হত্যাকাণ্ডের স্মারকগুলোর সুরক্ষা খুব প্রয়োজন। এতে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের কাছে বর্তমান প্রজন্মের যেই ঋণ আছে, সে ঋণ শোধ হতে পারে। দেশ স্বাধীন না হলে তো আমরা কিছুই পেতাম না। হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের অনেক আকাঙ্ক্ষাই হয়তো পূরণ হয়নি। অনেকের স্বপ্ন ছিল, সেখানে আশাভঙ্গ হয়তো হয়েছে; কিন্তু যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের ঋণ অস্বীকার করা যাবে না। আমরা দেখেছি, বধ্যভূমিগুলো সময়ের পরিক্রমায় স্থাপনা হয়ে গেছে। এগুলোর স্মারক থাকা দরকার ছিল, অর্থাৎ এখানে মুক্তিযুদ্ধে এতজন শহীদ হয়েছেন। তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি থাকার দরকার ছিল। এটি সরকারিভাবে না হলেও ব্যক্তি উদ্যোগে করা যেত। এ তো গেল আমাদের করণীয়।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এ ব্যাপারে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে এই অর্থে যে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসহ বিভিন্ন সংগঠন কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তাতে জেনোসাইডের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে কিছু গবেষণা হয়েছে, একাডেমিক কাজ হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে অনেকের কাজে বাংলাদেশের গণহত্যা স্বীকৃতি পেয়েছে।
অন্তত বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকলেও বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানি বর্বরতার বিষয়টি স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আর্জেন্টিনা, হংকং, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়। একাধিক বিদেশি গবেষকও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। কিন্তু জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে এ গণহত্যার স্বীকৃতির দাবি জোরালো হয়েছে। জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেতে আরও পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে সে জন্য কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া মুক্তি সম্ভব ছিল না। তবে মুক্তিযুদ্ধ ছিল বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞ। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ নিয়ে লড়াই হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অনেকে সাহায্য করেছেন। এভাবে যারাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সবাইকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা যাবে না। কাউকে সম্মান করতে গিয়ে অপরকে যেন অসম্মান না করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা, তিনি রাজনীতিবিদ হোন বা সেনাবাহিনীর সদস্য হোন কিংবা সাধারণ মানুষ হোক কিংবা শিল্পী-সাহিত্যিক হোক; যে যেভাবেই মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন, সেভাবে তাদের সম্মান করা দরকার।
ডা. সারওয়ার আলী: ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
- বিষয় :
- দিবস