ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

অভিমত

কৃষক রক্ষায় কৃষি কমিশন প্রয়োজন

কৃষক রক্ষায় কৃষি কমিশন প্রয়োজন

ফাইল ছবি

ড. জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:০৭ | আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫ | ০৭:৩২

কৃষিপণ্যের বাজার ব্যবস্থা কৃষকের অনুকূলে নেই। এর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বড় ব্যবসায়ী, মিলার ও তাদের সিন্ডিকেটের হাতে। বাজারে কৃষিপণ্যের মূল্য তারাই নির্ধারণ করে। এতে উৎপাদনকারী কৃষক ও ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বাজারে খামার প্রান্তের ক্রয়মূল্য ও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের বিক্রয়মূল্যের পার্থক্য বেশি। এর পুরো সুবিধা নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। তারা শস্যের প্রক্রিয়াজাত করে, মূল্য সংযোজন করে এবং বাজারে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা হাতিয়ে নেয়। 

এবার আলু ও সবজির মূল্য ধসে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত উৎপাদনকারী কৃষকরা। জমি চাষ, শ্রমিকের মজুরি, বীজ, সার, কীটনাশক ও সেচ খরচ উচ্চহারে পরিশোধ করে তারা অনেকটা নিঃস্ব। কৃষিকাজে বড় দাগে লোকসান গুনতে হয়েছে তাদের। 

পৃথিবীর কৃষিপ্রধান দেশগুলোর কৃষকদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা স্কিম আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো স্কিম নেই। উৎপাদন মৌসুমে দাম কমে যাওয়া একটা স্বাভাবিক ঘটনা। উৎপাদন মৌসুম ছাড়া অন্য সময় দাম বেশি থাকে। এ সমস্যা আদিকাল থেকেই কৃষিপণ্যের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু দাম প্রতিটি পর্যায়ে কী রকম হবে, তা নির্ধারণের জন্য প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের কখনও কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি। বছরব্যাপী কৃষিপণ্যের চাহিদা নিরূপণ, সরবরাহ নিশ্চিত করতে উৎপাদন, আমদানি ও মজুত লক্ষ্য নির্ধারণের কাজ করার কথা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের। এমনকি বিকল্প কৃষিপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার গুরুদায়িত্ব দেওয়া আছে শতবর্ষী এ সংস্থাকে। অথচ এসবের কোনো কিছুতেই কৃষি বিপণনের দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। কৃষক-ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে সক্রিয় করতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ কাম্য।

বাংলাদেশে আলুর জন্য রয়েছে ৩৬৬টি সরকারি-বেসরকারি হিমাগার। কিন্তু সবজির জন্য কোনো বিশেষায়িত হিমাগার নেই। তাই পচনশীল কৃষিপণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষকরা। প্রান্তিক পর্যায়ে যেন দাম বেশি না পড়ে যায়, সে জন্য দুটি কাজ করার কথা বলা হয়। কিছুদিনের জন্য কিছু পণ্য কোল্ডস্টোরেজে রাখা এবং উৎপাদন মৌসুমে সেসব পণ্য ধরে রাখা। তাহলে বাজারে দামের ভারসাম্য রক্ষা হবে। 

বিভিন্ন পণ্যের জন্য বিভিন্ন মাত্রায় কোল্ডস্টোরেজ দরকার। শুধু বিনিয়োগ দিয়ে হিমাগার বা প্রসেসিং ইউনিট করলেই হবে না। এর পাশাপাশি প্রয়োজন কৃষকের সঙ্গে সরকারের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে ভোক্তার কাছে নিয়ে আসা। এ জন্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলেছিল, তারা সরাসরি ভোক্তার জন্য মার্কেট চালু করবে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই ভালো ফল দেয়নি। 

ভারত ‘মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইজ’ নামে একটি স্কিম চালু করেছে, যা কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের নির্দিষ্ট দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। এ ছাড়া ‘ফসল বীমা কর্মসূচি’ও রয়েছে সেখানে। ভারতে প্রায় ২৩টি পণ্য সরকার কিনে নিয়ে স্টক করে। পরে যখন মৌসুম চলে যায়, তখন বাজারে সেই পণ্য ছাড়ে। তাতে বাজারে সেই পণ্যের দাম তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। আমাদের দেশে এমন কোনো উদ্যোগ নেই।

রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, মূল্যস্ফীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি– এসব মোকাবিলা করে বড় কোনো বিপর্যয় ছাড়াই এ দেশের মানুষ এখনও টিকে আছে। এর সবচেয়ে বড় অবদান কৃষকের। অথচ দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে সবচেয়ে অবহেলার শিকার হন তারা। বাম্পার ফলন করেও কৃষক সীমাহীন দুর্ভোগ ও লোকসানের মুখে পড়ছেন। এক কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকদের খরচ হয়েছে ২২ থেকে ২৫ টাকা। কিন্তু মাঠ থেকে মাত্র ১৪ টাকায় বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। এত বড় লোকসানের বোঝা তারা সইবেন কী করে!

দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। তাদের কাজে সহায়তার জন্য কৃষি খাতের পুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা দরকার। এ জন্য দরকার কৃষি কমিশন গঠন করা। এই কমিশন কৃষি ব্যবস্থার বিস্তারিত পর্যালোচনা উপস্থাপন করে ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণে সুপারিশ করতে পারে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ও প্রাক্তন উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ

আরও পড়ুন

×