ঢাকা রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫

অভ্যুত্থানের চেতনায় অন্যরকম বৈশাখ

২ হাজার ৬০০ ড্রোন ব্যবহার করে মোটিফ প্রদর্শনী

অভ্যুত্থানের চেতনায় অন্যরকম বৈশাখ

পহেলা বৈশাখে রাজধানীতে বর্ণিল ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্যে আয়োজিত এ শোভাযাত্রায় অংশ নেন বিভিন্ন শ্রেণি- পেশা ও সম্প্রদায়ের হাজারো মানুষ -মাহবুব হোসেন নবীন

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:১৩ | আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫ | ০৬:৪৭

পহেলা বৈশাখে গোটা দেশ ছিল আনন্দে মাতোয়ারা। নববর্ষের উচ্ছ্বাসে শামিল হয়েছিলেন সর্বস্তরের মানুষ। সর্বজনীন এ উৎসবে ছিল প্রাণের ছোঁয়া। সঙ্গে ছিল উজ্জ্বল সমৃদ্ধিময় নতুন দিনের প্রত্যাশাও। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পালাবদলের পর এটাই ছিল প্রথম বাংলা নববর্ষ উদযাপন। তাই নতুনভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনায় ১৪৩২ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানানোর আয়োজন ছিল একটু অন্যরকম। দেশজুড়ে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ ছাড়াও ছিল বর্ণাঢ্য সব আয়োজন। গ্রাম-শহরে বৈশাখী মেলা, যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, নাগরদোলা ছাড়াও ছিল ঐতিহ্যবাহী খাবার পান্তা-ইলিশ। সঙ্গে হালখাতা পালনের ঐতিহ্য। 

রাজধানীতে পহেলা বৈশাখের মূল আকর্ষণ ছিল ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। উৎসুক মানুষ সোমবার সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা ও শাহবাগ এলাকায় জড়ো হতে থাকেন। সেখানে ঢল নামে মানুষের। ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’– এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে শোভাযাত্রাটি সকাল ৯টার দিকে চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয়। শোভাযাত্রায় ১৬ ফুট লম্বা আলোচিত ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব মোটিফটি সবার নজর কাড়ে। সেখানে ১০০ ফুটের সুবিশাল পটচিত্রে বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়। আদিবাসী, গ্রামবাংলার কৃষক এবং নারী ফুটবল দলের অংশগ্রহণ ছিল শোভাযাত্রায়। রংবেরঙের পোশাকে আপামর জনতা, বিদেশি নাগরিককেও এতে অংশ নিতে দেখা যায়।

শোভাযাত্রায় ‘মুগ্ধর পানির বোতল’, জুলাই আন্দোলনের স্মৃতি মোটিফ এবং ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে একফালি তরমুজ স্থান পায়। এতে ‘হাসিনার বিচার কর’, ‘জুলাই গণহত্যার বিচার কবে?’, ‘ভারতের সাথে সকল অসম চুক্তি বাতিল কর’, ‘নদী বাঁচাও’– ইত্যাদি প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। এ ছাড়া বামবার সদস্যদের গিটার হাতে ‘অবাক ভালোবাসা’ গান পরিবেশন; ডিএমপির সুসজ্জিত ঘোড়া দল ও রিকশা প্রদর্শনী; নবপ্রাণ আন্দোলনের তত্ত্বাবধানে সাধু ও বাউলদের অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন আকৃতির মুখোশ শোভাযাত্রায় ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। 

শোভাযাত্রাটি শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র ও দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে আবার চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হয়। 

সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) মামুন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী প্রমুখ শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন। 

শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘এটা বাঙালির প্রাণের উৎসব নয়, এটা বাংলাদেশের প্রাণের উৎসব।’ উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একটু মুক্ত পরিবেশে আমরা একত্র হয়েছি।’ 

শোভাযাত্রার নিরাপত্তার স্বার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা ও আর্চওয়ে স্থাপন ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়। 

রমনা বটমূলে সূচনা
রাজধানীর রমনা বটমূলে ভোর সোয়া ৬টার দিকে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করে ছায়ানট। ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’– এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বাঙালির ঐতিহ্যের শেকড়কে ফের উজ্জীবিত করার কথাই গান ও কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা। 

অনুষ্ঠানে রাগ ভৈরবীর পর সম্মেলক গানের পর্বে রবীন্দ্র, নজরুল ও লালনের গানসহ নানা সুরের সংগীত পরিবেশন করা হয়। ছিল কবিতা আবৃত্তিও। এ বছরের কথন পাঠ করেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী। এর পর ফিলিস্তিনি গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বর্ণাঢ্য এই আয়োজন। 

কনসার্ট ও ড্রোন শো
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিকেল ৩টায় শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ছিল কনসার্ট ও ড্রোন শো। শুরুতেই দর্শক মাতায় বান্দরবানের বেসিক গিটার লার্নিং স্কুল। এর পর বিভিন্ন ব্যান্ড দল ও শিল্পীরা মনোমুগ্ধকর সংগীত পরিবেশন করেন।

সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হয় মূল আকর্ষণ ‘ড্রোন শো’। চীন ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে এবং ঢাকার চীনা দূতাবাসের সার্বিক সহযোগিতায় প্রায় ১৫ মিনিটের এই শোতে ২ হাজার ৬০০ ড্রোন ব্যবহার করে ১২টি মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়। ১৩ চীনা পাইলট বা ড্রোন চালনাকারী বিশেষজ্ঞের পরিচালনায় ‘ড্রোন শো’র শুরুতে ছিল শোষণ-শাসনের অবসানের প্রতীক হিসেবে খাঁচার ভেতর থেকে উড়াল দেওয়া পাখির প্রদর্শনী। এর পর ফুটিয়ে তোলা হয় গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধকে। আরেকটি ছবিতে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে প্যালেস্টাইনের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানানো হয়। 

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, সংস্কৃতি সচিব মফিদুর রহমান, শিল্পকলা একাডেমির সচিব ও মহাপরিচালক (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেন, ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিরা। 

রাজধানীতে নানা আয়োজন
ঢাবি সংগীত বিভাগের আয়োজনে সকাল ৮টার দিকে কলা ভবনের সামনের বটতলায় বর্ষবরণের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে নিরূপম প্রামাণিকের তবলায় ও কাননের বাঁশীবাদনে আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে, এসো হে বৈশাখ এসো এসোসহ নানা সংগীত পরিবেশন করা হয়। ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরে ভোর ৬টায় সুরের ধারা ও চ্যানেল আইয়ের যৌথ আয়োজনে ‘হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর পর স্মৃতিচারণ ও পহেলা বৈশাখ নিয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ সংগীত পরিবেশন করেন ফেরদৌস আরা, ফাহিম হোসেন, কিরণ চন্দ্র রায়, প্রিয়াংকা গোপ, অনন্যা আচার্য প্রমুখ। 

বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে বর্ষবরণ সংগীত, নববর্ষ বক্তৃতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। বক্তব্য দেন প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ। সভাপ্রধানের বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সাত দিনের বৈশাখী মেলা শুরু হয়েছে। মেলায় যাত্রা, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাসসহ বিনোদনমূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আয়োজনে শুলশানের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি পার্কে বৈশাখী মেলা এবং হাতিরঝিলে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া গুলশানের আলোকিতে বৈশাখী মেলা এবং রিশকা ফেস্টে বিভিন্ন মুখরোচক দেশি খাবারের পাশাপাশি পোশাক ও অলংকার পাওয়া যাচ্ছে। 

বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সোমবার গুলিস্তানের শহীদ কর্নেল তাহের মিলনায়তনে দিনভর বৈশাখী মঙ্গল মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আয়োজনে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রীতিভোজ আড্ডা, গল্প ও আলোচনা। 

জাতীয় প্রেস ক্লাবে ছিল দিনভর বর্ণিল আয়োজন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিও (ডিআরইউ) নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। 

মহানগর সর্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটি ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে দুই দিনব্যাপী ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণ, মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

আরও পড়ুন

×