ঢাকা শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস

নিদর্শনগুলো প্রজন্মের সেতুবন্ধ

নিদর্শনগুলো প্রজন্মের সেতুবন্ধ

বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ। সম্প্রতি তোলা -সমকাল

মো. সেরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:২১

একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈচিত্র্য যত সমৃদ্ধ, সে জাতি তত বেশি শক্তিশালী। তাই প্রতিটি সভ্য জাতি তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় এখন সচেষ্ট। দেশে দেশে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার বৈশ্বিক প্রয়াস হিসেবে প্রতিবছর ১৮ এপ্রিল পালিত হয় বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ পালিত হবে দিনটি। 

১৯৮২ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস’ তিউনিসিয়ায় এক আলোচনা সভায় ১৮ এপ্রিলকে দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৩ সালে দিনটি ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস’ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী এ দিবস উদযাপনের উদ্দেশ্য ক্রমপরিবর্তনশীল মানবসভ্যতার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এই দিন মানুষকে তার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের গুরুত্ব অনুধাবনে উদ্বুদ্ধ করে। প্রাচীন সাংস্কৃতিক উপাদান ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো একটি প্রজন্মের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে রচনা করে সেতুবন্ধ। এই দিবস পালনের তাৎপর্য– সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণ, বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক বিনিময়, সচেতনতা বৃদ্ধি ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে উদ্বুদ্ধ করা।

সমৃদ্ধ ইতিহাস, বহুমাত্রিক ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশেও এ দিবস পালনের গুরুত্ব অসীম। কারণ, এখানকার প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভ থেকে শুরু করে পুরঃস্থাপত্যসহ ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের রক্ষা করতে হবে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য– ‘দুর্যোগ ও সংঘাতের হুমকির মুখে ঐতিহ্য’। 

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গৌরবময়। বিগত প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও অধিক সময়ে নির্মিত অনেক পুরাকীর্তি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। আমাদের রয়েছে উয়ারী-বটেশ্বর, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ভিতরগড়, ময়নামতির মতো অসংখ্য ঐতিহ্যিক নিদর্শন। একদিকে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, ষাটগম্বুজ মসজিদ ইত্যাদি পরিমেয় ঐতিহ্য, অন্যদিকে বাউলসংগীত, জামদানি, পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা, শীতলপাটি ও রিকশাচিত্র ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। আরও সাতটি ঐতিহ্য ইউনেস্কোর স্বীকৃতির খসড়া তালিকাভুক্ত।
২০২০ সালে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নীতিমালার একটি জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু এ পরিকল্পনায় পুরাকীর্তি সংরক্ষণের বিষয়ে কিছু বলা নেই। কেবল পুরাকীর্তি নয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে বিভিন্ন জাদুঘর সংরক্ষণের বিষয়েও আমাদের পরিকল্পনা থাকা দরকার। বাংলাদেশের কোন এলাকায় কোন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিতে পারে, তা চিহ্নিত করা দরকার। কোন এলাকায় কী পুরাকীর্তি রয়েছে, তার তালিকা করা প্রয়োজন। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় পুরাকীর্তি সংরক্ষণের ব্যাপারে অন্যান্য দেশ কী করছে, তা জানা দরকার। নদীভাঙন যেসব পুরাকীর্তির জন্য হুমকি, সেগুলোর জন্য দরকার পৃথক চিন্তাভাবনা। 

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের আশঙ্কা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৪ সালে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে নেপালের অনেক পুরাকীর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নেপাল কীভাবে এ ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছে, সে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের এখনই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বিবেচনায় নিতে হবে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পুরাকীর্তি সুরক্ষা বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। সুন্দরবন ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ আমাদের বিশেষ প্রাকৃতিক সম্পদ। এগুলো রক্ষা করার লক্ষ্যেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। 
সবার আগে দরকার সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি। তার পর উপযুক্ত সুরক্ষা কৌশল ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। বৈচিত্র্যময় অভিব্যক্তি প্রকাশের বাধামুক্ত সাংস্কৃতিক পরিসরের সম্প্রসারণ এবং বৈশ্বিক ও স্থানীয় ঐতিহ্য বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অতীতের অর্জন ও গৌরবগাথা সংরক্ষণ হোক বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস পালনের অঙ্গীকার। 
লেখক : উপপরিচালক, জাতীয় জাদুঘর
 

আরও পড়ুন

×