ঢাকা রবিবার, ১৮ মে ২০২৫

সিপিডির সংলাপ

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক: দরকষাকষিতে রাজনৈতিক কৌশল নিতে হবে

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক: দরকষাকষিতে রাজনৈতিক কৌশল নিতে হবে

ঢাকার লেকশোর হোটেলে বৃহস্পতিবার সিপিডির ‘ট্রাম্প রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ অ্যান্ড বাংলাদেশ: ইমপ্লিকেশন্স অ্যান্ড রেসপন্স’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা- সমকাল

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:২৬ | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫ | ১০:০৯

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। বিশেষ করে চীন-মার্কিন শুল্ক লড়াইয়ের প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়, তা এখনও বলা যাচ্ছে না। এ রকম বাস্তবতায় একক প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে; খুঁজতে হবে বিকল্প বাজার। জোটগত প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের পণ্যের হিস্যা বাড়ানো যায়। এশিয়ার দেশগুলোতে মনোযোগ বাড়াতে হবে। অন্যদিকে, শুল্ক কমালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে করা যাবে না বিধায় সে দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) চেষ্টা করতে হবে।

ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার গবেষণা সংস্থা সিপিডি আয়োজিত এক সংলাপে এমন মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান সংলাপে বিশেষ বক্তা ছিলেন। বিষয়ের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থার সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সংলাপ পরিচালনা করেন।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুধু আমদানি-রপ্তানির ইস্যু নয়, রাজনৈতিকও বটে। সে দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়ের সঙ্গে আলোচনায় শুল্ক শর্ত মানা হলে তারা নতুন ইস্যু তৈরি করবে। শুধু দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য নয়, বরং উচ্চ পর্যায়ের সম্পর্ক অন্যতম বিষয়। সে ক্ষেত্রে দরকষাকষিতে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক কৌশল নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে অন্য দেশ কোন পথে এগোচ্ছে, তা বুঝে নিজেদের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। 

রেহমান সোবহান আরও বলেন, ইইউর বাজারে কয়েক বছর বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের বাজারে মনোযোগ বাড়াতে হবে। এশিয়ার অন্যান্য বাজারেও রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব। আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র হবে এশিয়া। 

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এশিয়ার মধ্যে চীন বছরে ২ হাজার ৮০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। ভারত আমদানি করে ৭৫০ কোটি ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত চীনে এক বিলিয়ন ও ভারতে দুই বিলিয়ন ডলারের কম রপ্তানি করে। এসব বাজার ধরতে পণ্য ও বাজার বহুমুখী করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব। 

এফটিএ করার সুপারিশ
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কভার এড়াতে বিভিন্ন বিকল্প হিসেবে দেশটির সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করারও সুপারিশ করেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান বলেন, প্রথমেই বুঝতে হবে যুক্তরাষ্ট্র যা আরোপ করেছে, তা ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নয়। ফলে বাংলাদেশ যেভাবে যতই সাড়া দিক না কেন, তাতে কোনো লাভ নেই। বরং বুঝতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র কী চায়। আরেকটি ভালো উপায় হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ করা। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ করা সহজ নয়। এর আগেও বহুবার বাংলাদেশ এ প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশ এফটিএ করার জন্য প্রস্তুত নয়। প্রসঙ্গত, রপ্তানি বাজারে প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ করার চেষ্টা করছে। ভারতও একই চেষ্টা করছে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, গত ২ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর বিশ্ব বাণিজ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ, কীভাবে এ সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে কী প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব। এ বিষয়টি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সুবিধা নেওয়ার জন্যই নয়, একই সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও এ পদক্ষেপ কাজে আসবে। কারণ, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা বা জিএসপি থাকবে না। তখন ‘জিএসপি প্লাস’ সুবিধা পাওয়ার বিষয় রয়েছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে প্রস্তুতি হিসেবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ করতে হবে। প্রতিযোগী ভিয়েতনাম অনেক দেশের সঙ্গে এফটিএ করেছে। আরও অনেক দেশ তাদের তালিকায় আছে। এমনকি কম্বোডিয়াও এফটিএ করছে। বাংলাদেশকেও এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। 

কোন দেশ কত শুল্ক আদায় করে
মূল প্রবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি পরিস্থিতি তুলে ধরেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ হাজার ৫১৫টি পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২ হাজার ২১৮টিতে শুল্ক রয়েছে। আর ২৯৭টিতে আমদানি শুল্ক নেই। গড় শুল্ক ৬ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয় বাংলাদেশের ১ হাজার ২০৮টি পণ্য, যার মধ্যে ৯২৭টিতে শুল্ক রয়েছে। ২৮১টি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। এতে গড় শুল্ক দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাবদ ১৮ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের পণ্যের আমদানি শুল্ক থেকে ১২৭ কোটি ডলার আয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যে ভারসাম্য আনতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক অব্যাহতি দিলে একই সুবিধা দিতে হবে, অর্থাৎ শুধু শুল্ক কমিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। 

অন্যান্য আলোচনা
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও শাসা ডেনিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, মার্কিন শুল্ক আরোপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি দুই বিলিয়ন ডলার কমে যেতে পারে। চীন, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশের রপ্তানিও বিভিন্ন পরিমাণে কমবে। এসব দেশ এখন ইইউ বাজারে রপ্তানি বাড়াতে চাইবে। এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে ইইউর ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের দাম কম দেওয়ার চেষ্টা করবে। 

বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের বিষয়টি অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ইতোমধ্যে আরোপ করা বাড়তি ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্কের অর্ধেকটা যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা সরবরাহকারীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে বলছেন। এই ধাক্কা বড় কারখানা সামলাতে পারলেও ছোট ও মাঝারিদের জন্য নীতি-সহায়তা দরকার।

এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপ বুঝিয়ে দিল, কত দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এ অবস্থায় রপ্তানির গতি ধরে রাখতে একটি পথনকশা দরকার। গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক শ্রমিকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে আতঙ্ক না ছড়িয়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। সংলাপে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাসরুর, শ্রমিক নেতা বাবুল আখতার প্রমুখ।

আরও পড়ুন

×