প্রকৃতি
সবুজের ক্যানভাসে বেগুনি ফুলের দোল

চবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে গাছে গাছে বেগুনি জারুল ফুল। সোমবার তোলা -সমকাল
মারজান আক্তার, চবি
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:১৮ | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৫ | ০২:৪১
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পুরাতন কলা ও মানববিদ্যা ভবনের চতুর্থ তলা। বৈশাখের দুপুরে একটি কক্ষে চলছে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের পাঠদান। জানালার পাশে বসা শিক্ষার্থী আইয়ুবুর রহমান তৌফিক তখন তীব্র গরমে হয়রান। এ সময় হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল জানালার বাইরে জারুল ফুলের গাছে। একদল বেগুনি রঙের ফুল দেখে চনমনে হয়ে উঠলেন তৌফিক। ফুলের সৌন্দর্যের সঙ্গে বাইরে থেকে আসা ঝিরিঝিরি হাওয়ায় মুহূর্তে তাঁর ক্লান্তি চলে গেল।
শুধু তৌফিক নন; বেগুনি, হলুদ ও লাল রঙের ফুল এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রাণ জুড়াচ্ছে। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা চবি ক্যাম্পাসে রূপ ও ঋতুর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় স্পষ্ট। এখানে শীত কিছুটা দেরিতে বিদায় নেয়। পাতাঝরার মৌসুম শেষে মার্চে গাছে গাছে শুরু হয় নতুন পাতা গজানোর প্রতিযোগিতা। সেই পাতার আড়ালে ধীরে ধীরে ফোটে রঙিন ফুল। কাটাপাহাড়ের রাস্তা ঘিরে বেগুনি জারুল, কেন্দ্রীয় মাঠের কিনারা ধরে সোনালু ফুলের স্বর্ণছায়া ও নীরা পাহাড়ের কোলঘেঁষে কৃষ্ণচূড়ার ঝাঁক। এভাবে লাল, হলুদ, বেগুনি রঙে ছেয়ে যায় পুরো ক্যাম্পাস।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন চলছে বিভিন্ন ফুলের উৎসব। ক্যাম্পাসে সবচেয়ে বেশি জায়গা করে নিয়েছে জারুল। রাস্তার ধারে, হল প্রাঙ্গণে, লাইব্রেরির পাশ ঘেঁষে ও ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জারুল গাছে ফুটেছে ফুল। সবুজের ক্যানভাসে বেগুনি রঙের এই অনন্য সংমিশ্রণ জায়গা করে নিয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনে। গাছের ডালজুড়ে থোকা থোকা ফুল, তার নিচে ঝরে পড়া ফুল রঙিন চাদর বিছিয়েছে যেন। তারই মাঝই হাঁটতে গিয়ে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পান শিক্ষার্থীরা।
বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাবাসসুম জেরিন বলেন, ‘জারুল আমার কাছে কেবল ফুল নয়, অনুভব। যখন ক্যাম্পাসজুড়ে বেগুনি ফুল ফোটে, তখন মনে হয় প্রকৃতি ভালোবাসতে ভুলে যায়নি।’
জেরিনের মতো অনেকেই ব্যস্ত শিক্ষাজীবনের কয়েক মুহূর্ত কাটান জারুল কিংবা সোনালু ফুলের গাছের নিচে। তাদের একজন সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী আবির হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিদিন হল থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশ ধরে হেঁটে ক্লাসে যাই। গাছের ফুল, নিচে ছড়িয়ে থাকা পাপড়ি– এ রকম দৃশ্য দেখতে দেখতে হাঁটলে মনটাই আনন্দ ভরে ওঠে। বন্ধুদের নিয়ে আমরা সেখানে প্রায়ই ফটোশুট করি। ক্যাম্পাসে জারুল-সোনালুকে ঘিরে স্মৃতি জমিয়ে রাখি।’
শিক্ষকরাও প্রকৃতির এই রূপকে দেখেন এক ধরনের সৃজনশীলতার উৎস হিসেবে। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মেজবাউল আলম বলেন, ‘ফুলের এই নিঃশব্দ উপস্থিতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে আবেগ, চিন্তা ও সৃজনশীলতার জন্ম দেয়, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেক সময় দেখি, ক্লাসে এসে শিক্ষার্থীরা প্রকৃতি প্রসঙ্গে লিখছে, ভাবছে। এমন এক প্রাকৃতিক আবহে শিক্ষা যেন আরও গভীর হয়, প্রাণবন্ত হয়।’
সৌন্দর্য বিলানোর পাশাপাশি জারুল, সোনালু গাছের ঔষধি গুণও রয়েছে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান ও ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সে গবেষণা হয়ে থাকে। এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক জরিন আখতার জানান, জারুলের বৈজ্ঞানিক নাম Lagerstroemia speciosa, সোনালুর Cassia fistula। সোনালু বনজ উদ্ভিদ, যার বাকলে রয়েছে ডায়রিয়া ও ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে কার্যকর ঔষধি গুণ। জারুল গাছেরও রয়েছে পরিবেশগত ও ঔষধি গুরুত্ব। এর পাতা, ফুল, বাকলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রদাহনাশক উপাদান থাকায় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহার হয়।
- বিষয় :
- প্রকৃতি