বেশির ভাগ আসামিকে চেনেন না বাদী

.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:২৭ | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৫ | ০৯:১৫
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রায় ৯ মাস পর করা একটি হত্যা মামলা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। গুলিতে প্রাণ হারানো মাহফুজ আলম শ্রাবণের ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পী মামলাটির বাদী। মামলায় তিনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ব্যবসায়ী, সাংবাদিক মিলে ৪০৮ জনকে আসামি করেছেন। কিন্তু বেশির ভাগ আসামিকেই তিনি চেনেন না বলে গণমাধ্যমকে জানান। এই মামলা নিয়ে সোমবার কথা বলেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বাহারুল আলম। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘বাংলাদেশের আইনে কোথাও মামলা করার ক্ষেত্রে বাধা নেই। যে যার মতো মামলা করছে। অনেক হয়রানিমূলক মামলা হচ্ছে।’
হত্যা মামলাতে অভিনেতা ইরেশ যাকেরকে আসামি করার বিষয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, ‘এটি খুবই বিরক্তিকর ও উদ্বেগজনক।’ এদিকে ভুয়া মামলার বাদীর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বাহারুল আলম বলেন, ‘মামলা হলেই গ্রেপ্তার করা যাবে না। তদন্তে যার দায়ভার পাওয়া যাবে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ হত্যা মামলায় ২৪ সাংবাদিককে অভিযুক্ত করায় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। শুধু এই মামলাই নয়, জুলাই আন্দোলনের ঘটনায় হওয়া আরও বেশ কিছু মামলার বাদী আসামিদের চেনেন না বলে এর আগেও গণমাধ্যমকে বলেছেন। মামলা দিয়ে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার খবরও বেরিয়েছে সংবাদ মাধ্যমে।
২০ এপ্রিল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. হাসিবুজ্জামানের আদালতে মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পী ৪০৮ জনের নামে মামলার আবেদন করেন। ওই দিন আদালত তাঁর জবানবন্দি রেকর্ড করে অভিযোগটি মিরপুর মডেল থানার ওসিকে এজাহার হিসেবে নিতে নির্দেশ দেন। সোমবার সন্ধ্যায় বাপ্পী সমকালকে বলেন, ‘বেশির ভাগ আসামিকে চিনি না। সব আসামিকে চেনা সম্ভবও না।’
মামলায় কার নাম কীভাবে ঢুকেছে, জানি না: বাদী
বাদী মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পী গতরাতে সমকালকে বলেন, ‘আমি আদালতে উপস্থিত ছিলাম না। তাই কে কীভাবে যুক্ত হলো, তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালনের সময় কিছু নাম যুক্ত করেছে; আইনজীবীরাও কিছু নাম দিয়েছেন। আমি নিজেও পত্রিকা থেকে তথ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্টদের নাম দেওয়ার চেষ্টা করেছি। একা কোনো ব্যক্তির পক্ষে এত বড় মামলা করা সম্ভব না। যদি শুধু আমি করতাম, ১০ জন বা সর্বোচ্চ ৫০ জনের নাম দিতাম।’
না চিনলেও কেন এত লোককে আসামি করা হয়েছে– জানতে চাইলে বাপ্পী বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে অনেকেই তো চেনা। এ ছাড়া বিভিন্ন মাধ্যম, মিডিয়া থেকে অনেকের বিষয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। এর পরই মামলা করা হয়েছে।িবকিhd’ মামলায় কতজন আসামি জানতে চাইলে বলেন, ‘৪০৭ জন আসামি।’ যদিও এজাহারে আসামির সংখ্যা ৪০৮। একজনের হত্যার সঙ্গে এত লোক যুক্ত কিনা– জানতে চাইলে বাপ্পী বলেন, ‘খুনি তো মূলত দেশপ্রধান। তারপর তাঁকে যারা সহায়তা করেছে। মামলা দুর্বল হলে হোক। বাকি কাজ কোর্ট আর থানা পুলিশের।’ আসামিদের মধ্যে আপনি কতজনকে চেনেন– জানতে চাইলে বাদী বলেন, ‘মোটামুটি যারা পপুলার তাদের তো চিনি। আমিও রাজনৈতিকভাবে একটু ওঠাবসা করি।’
অনেক হয়রানিমূলক মামলা হচ্ছে
গতকাল ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবসের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, যে যাঁর মতো মামলা করছেন। অনেক বিদ্বেষমূলক মামলা হচ্ছে। মামলা করে ফেলার পর পুলিশ-আদালত প্রশাসনের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিকার দেওয়ার চেষ্টা করছি। যখন এত বেশি লোককে আসামি করা হয়, এত মামলা করা হয়, তা আমাদের জন্যও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। উপদেষ্টা বলেন, মামলা হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, অভিযোগের কোনো বস্তুনিষ্ঠতা পাওয়া না গেলে কাউকে যেন গ্রেপ্তার করা না হয়। আবার আদালতের পক্ষ থেকেও যেখানে বস্তুনিষ্ঠতা নেই, সেখানে যতভাবে আইনি প্রতিকার দেওয়া সম্ভব, সেটি দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ভুয়া মামলা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে: আইজিপি
পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বাহারুল আলম বলেন, ‘মামলা এখন সবাই নিজের হাতে লিখে নিয়ে আসে। সেটি পুলিশকে মামলা হিসেবে দায়ের করতে হয়। যাচাই করার সুযোগ নেই। পরে তদন্ত করে দেখা হয় অভিযোগ কতটুকু সত্য, কতটুকু মিথ্যা। সত্যটুকু তদন্তে উঠিয়ে আমরা আদালতে পাঠাই। যারা মনে করছেন, তিনি অপরাধী নন, তিনি স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যাবেন। তবে অনেকে মামলা করে বাণিজ্য করছেন বলেও অভিযোগ আসছে। যারা এ রকম ভুয়া মামলা করছেন, সেই বাদীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আইজিপি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর অনেকে অসৎ উদ্দেশ্যে, মানুষের কাছ থেকে টাকাপয়সা আদায়ের জন্য মামলা করেন। অপরাধ হয়তো করেছে ৫-১০ জন; তার সঙ্গে আরও ৩০০ জনের নাম দিয়ে মামলা করেছেন। ওই মামলাটি তেমনই একটি মামলা।’ আইজিপি বলেন, ‘এ ধরনের মামলায় যদি কেউ অসুবিধায় পড়েন তাহলে পুলিশকে জানান। গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা যেন না হয়। এ ক্ষেত্রে আমি থানায় ফোন করে বিষয়গুলো তদারক করছি।’
সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টার উদ্বেগ
সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ইরেশ যাকেরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। জুলাই আন্দোলনে তিনি যুক্ত ছিলেন। ইরেশ যাকেরের বিরুদ্ধে মামলা ‘ডিপলি ডিস্টার্বিং’। মামলা রাষ্ট্রপক্ষের নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, মামলা করেছেন এক ব্যক্তি। মামলা করার স্বাধীনতা সবার আছে। সেই স্বাধীনতার কেউ অপব্যবহারও করছেন। পুলিশ মামলাটির সঠিক তদন্ত করবে। যেটি সত্য, সেটির পক্ষে থাকবে। যেটি মিথ্যা, সেটি বাতিল করবে। ইরেশ যাকের বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
ডিইউজের প্রতিবাদ
এ হত্যা মামলায় ২৪ সাংবাদিককে অভিযুক্ত করায় ডিইউজে গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য হুমকি। পেশাদার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এভাবে মামলা চলতে থাকলে এ পেশা থেকে কখনোই ভয়ের সংস্কৃতি দূর হবে না।