বিইউপিতে সেমিনার
মিয়ানমারের সঙ্গে প্রক্সি যুদ্ধে জড়াবে না বাংলাদেশ
গৃহযুদ্ধের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ মো. তৌহিদ হোসেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

ফাইল ছবি
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৫ | ০১:১৮
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশ হয়ে জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে মানবিক করিডোর নিয়ে কোনো চুক্তি সই করেনি সরকার। এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কোনো পক্ষের সঙ্গে সমঝোতাও হয়নি। মানবিক করিডোরের নামে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ‘প্রক্সি ওয়ারে’ জড়াবে না বাংলাদেশ। এ নিয়ে যা প্রচার করা হচ্ছে, তা নিছক অপতথ্য ও গুজব।
গতকাল রোববার দুপুরে এক সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান। রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) স্বাধীনতা মিলনায়তনে ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: আঞ্চলিক নিরাপত্তায় কৌশলগত প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ পথ’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ (এএফডি) ও বিইউপি।
এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের মধ্যে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা না থাকায় তাদের প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
সেমিনারে আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করলেও বেশ কয়েকটি প্রতিবন্ধকতার বিষয় উঠে আসে। এর মধ্যে রয়েছে– রাখাইন অঞ্চলের বর্তমান অস্থিতিশীলতা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে আরাকান আর্মির অনিশ্চিত অবস্থান এবং ভৌগোলিক রাজনীতির বিভাজন।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যু ও বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে করিডোরের বিষয়টি নানা পর্যায়ে আলোচিত। ২৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলন থেকে নতুনভাবে এ আলোচনা শুরু হয়। ওই দিন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের জানান, রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের কাছে করিডোর দেওয়ার অনুরোধ করেছিল জাতিসংঘ। সংস্থাটির তত্ত্বাবধানে শর্তসাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডোর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এর পর একাধিক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, করিডোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সংসদ থেকে আসতে হবে।
করিডোরসহ নানামাত্রিক ঘটনা প্রবাহের মধ্যে গতকাল বিইউপিতে রোহিঙ্গাবিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান আরও বলেন, মিয়ানমারের যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইনে মানবিক করিডোর নিয়ে বাংলাদেশ কাউকে সম্মতি দেয়নি। এটি বিভ্রান্তিকর ও ভুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তিনি বলেন, রাখাইনে মানবিক তৎপরতা পরিচালনায় উভয় পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন। আমরা বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা বলেছে, যদি আরাকান আর্মি স্থল অভিযান বন্ধ করে তবে তারা বিমান হামলা চালাবে না। সংঘর্ষ হয়নি, বিমান হামলাও হয়নি। যুদ্ধে একটি বিরতি এসেছে– এটাই এ পর্যন্ত অর্জন। যুদ্ধে চলমান বিরতি স্থায়ী হলে শান্তি ও প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনার পথ তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, আমি এটাকে শান্তি বলছি না। কিন্তু যুদ্ধ না থাকাটা ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে পারলে শান্তির একটা সূচনা হতে পারে। যা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবে। তবে রাখাইনের বর্তমান প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি না হলে সেখানে টেকসই শান্তি আনা সম্ভব নয়।
রাখাইনে মানবিক করিডোর বিষয়ে বিতর্কের প্রসঙ্গ টেনে খলিলুর রহমান বলেন, এটা মানবিক করিডোর নয়। রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে চ্যানেলের বিষয়ে আলোচনা করেছে তারা। আর মানবিক করিডোর ও চ্যানেল এক নয়। এমন চ্যানেল হলে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তা পরিচালিত হওয়ার কথা। এর মাধ্যমে ত্রাণ ও খাদ্য যাবে।
রোহিঙ্গাদের কখনোই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না উল্লেখ করে খলিলুর রহমান বলেন, যদি সেটা করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ হবে প্রতিবেশী দেশগুলোর ডাম্পিং গ্রাউন্ড।
নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, আরাকান আর্মি ও ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের কোনো অবস্থান নেই। এটি জাতিগত নিধনের চিত্র। বাংলাদেশ জাতিসংঘের মাধ্যমে বিষয়টি মিয়ানমারকে জানিয়েছে। রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। আমরা মিয়ানমারের প্রতিক্রিয়া জানতে অপেক্ষা করছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যাচাইয়ের জন্য রোহিঙ্গাদের ছয়টি তালিকা দিয়েছে। মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার জনের যাচাই করা একটি তালিকা পাওয়া গেছে।
প্রতিবেশী দেশের গণমাধ্যমে রাখাইনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রক্সি যুদ্ধ’র বিষয়টি ভিত্তিহীন বলে মন্তব্য করে খলিলুর রহমান বলেন, ৮ এপ্রিল আমি একটি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছি, এটা অযৌক্তিক। এমনকি কক্সবাজারে ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির সঙ্গে একটি সাধারণ বৈঠককেও ‘গোপন সামরিক বৈঠক’ বলে উপস্থাপন করা হয়েছে।
খলিলুর রহমান বলেন, মিয়ানমারকে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছি আমরা তাদের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বকে সম্মান করি। এ ধরনের কূটনৈতিক প্রক্রিয়া জটিল এবং এগুলো ধৈর্য ও বিচক্ষণতা দিয়ে পরিচালিত করা উচিত। আমরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আত্মীকরণ করতে চাই না। সেটি করলে জাতিগত নিধনকে বৈধতা দেওয়া হবে– এটি আমাদের ‘রেড লাইন’।
তিনি আরও বলেন, অতীতে কূটনীতি ও সামরিক চাপের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা করা হয়েছে। এখন একটি টেকসই সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারের সহযোগিতা নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের একত্রীকরণ নয় বরং প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই মৃতপ্রায় বিষয়টিকে বিশ্বের কাছে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছে।
প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছায়
সেমিনারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, প্রত্যাবাসন অবশ্যই স্বেচ্ছায় হতে হবে। সেখানে থাকতে হবে নিরাপত্তা ও পূর্ণ নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা। তারা এমন জায়গায় ফিরে যাবে না যেখানে তাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা অধিকার অস্বীকার করা হয়।
সামরিক জান্তা, আরাকান আর্মি এবং ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টকে (এনইউজি) মিয়ানমারের প্রধান অংশীজন হিসেবে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, যে কোনো স্থায়ী সমাধানে অবশ্যই এই তিন পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে আরাকান আর্মিকে, যারা এখন রাখাইন রাজ্যের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারে অবশ্যই বাস্তব পরিবর্তন আনতে হবে। সেই পরিবর্তনের নিশ্চয়তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হতে হবে। যদিও এটি কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। ঐক্যবদ্ধ না হলে এটা সম্ভব হবে না। এ সময় রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার বিষয়ে একটি রোডম্যাপ থাকা দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন বিইউপির উপাচার্য মেজর জেনারেল মো. মাহবুব-উল আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান। তিনি রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির প্রভাব ও সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতির জটিলতা তুলে ধরে রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আঞ্চলিক অংশীদারের সমন্বিত সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রিসার্চ ডিরেক্টর আবু সালাহ মো. ইউসুফ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান তালুকদার প্যানেল আলোচক হিসেবে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
সাহাব এনাম খান বলেন, দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য প্রধান জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ হয়ে উঠেছে। যার প্রভাব মানবিক সাহায্যের বাইরেও রয়েছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধী নেটওয়ার্কের জড়িত থাকা এবং প্রত্যাবাসনের অব্যাহত অনুপস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা শিবিরের পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি এম হুমায়ুন কবির সেমিনারের উন্মুক্ত আলোচনা ও সারাংশ সেশন পরিচালনা করেন; যেখানে অংশগ্রহণকারীরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিষয়ক তাদের মত ও সুপারিশ তুলে ধরেন।
সেমিনারে কূটনীতিক, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও সামরিক অ্যাটাশে, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা, রোহিঙ্গাবিষয়ক বিশ্লেষক, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মকর্তা এবং বিইউপির শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।