ঢাকা শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫

আম রপ্তানিতে পদে পদে বাধা

আম রপ্তানিতে পদে পদে বাধা

কোলাজ

 জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫ | ০৫:৫৬ | আপডেট: ২৩ মে ২০২৫ | ০৭:৩৯

আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। শুধু পরিমাণের দিক থেকে দেশে ফলের রাজা হয়েছে, তা নয়। অন্তত ছয়টি জেলার প্রধান বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য এই আম। ২২টি জেলায় এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমের চাষ হচ্ছে। এত উৎপাদনের পরও রপ্তানির তলানিতে বাংলাদেশ। রপ্তানিকারকরা বলছেন, উড়োজাহাজের ভাড়া অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণে রপ্তানি কমেছে। এত বেশি দামে আম কিনতে চাচ্ছেন না বাইরের ক্রেতারা।

এ ছাড়া আম রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে রপ্তানিযোগ্য উন্নতজাতের আমের অভাব। স্থানীয় আমের জাতগুলোর জীবনকাল কম, দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। মানসম্মত কৃষি পদ্ধতির চর্চা, আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিংয়ের অভাব, নতুন বাজার সৃষ্টিতে সমন্বয়হীনতা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি আমের ব্র্যান্ডিং সংকটের কারণে রপ্তানিতে সুফল আসেনি। এ অবস্থায় সরকার আম রপ্তানি বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি নতুন বাজার খুঁজছে। গুণগত মান ঠিক রেখে আম উৎপাদন করে রপ্তানিতে এবার রেকর্ড গড়তে চায় কৃষি মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে। আগামী সপ্তাহে চীনে ৫০ হাজার টন আম রপ্তানি হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্য দেশের চেয়ে চীনে পরিবহন ব্যয় কম। ফলে গুণগত মান ঠিক রেখে আম উৎপাদন করতে পারলে কম পরিবহন ব্যয়ে বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার হয়ে উঠতে পারে দেশটি।

উৎপাদনে রেকর্ড, রপ্তানিতে করুণদশা

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। চলতি মৌসুমে প্রায় ২ লাখ ৫ হাজার ৩৪ হেক্টর জমিতে ২৭ লাখ টন আমের উৎপাদন হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলায় আম পাড়া শুরু হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২১ লাখ ৪৩ হাজার টন আম উৎপাদন হয়েছিল। এর মধ্যে রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ৩০৯ টন। ২০১৯-২০ সালে দেশে প্রায় ২৫ লাখ টন আম উৎপাদন হলেও রপ্তানি হয়েছে ২৮৩ টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে আমের ফলন হয়েছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার ৪৯৯ টন; রপ্তানি হয় ১ হাজার ৭৫৭ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ২৭ লাখ ৭ হাজার ৪৫৯ টন; রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ১০০ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ২৫ লাখ ৮ হাজার ৯৭৩ টন; রপ্তানি হয় ১ হাজার ৩২১ টন আম। 

রপ্তানিকারকরা বলছেন, তৈরি পোশাককে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পচনশীল রপ্তানি পণ্যকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। বিদেশি উড়োজাহাজগুলোকে পচনশীল রপ্তানি পণ্যের জন্য নির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দের শর্ত সরকারই আরোপ করতে পারে। এটি করা হলে এসব পণ্য নেওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকত।

উড়োজাহাজের এই সুবিধার পাশাপাশি রপ্তানিকারকরা বাড়তি প্রণোদনা চান। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৪৩টি রপ্তানি পণ্যে নতুন করে প্রণোদনার হার নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর মধ্যে ফলমূলসহ কৃষিপণ্যও রয়েছে। প্রণোদনার নতুন হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ, যা গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১৫ শতাংশ।

ঢাকা-লন্ডন রুটে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভাড়া ছিল কেজিতে ১৮৪ থেকে ২৪৩ টাকা, যা বেড়ে বর্তমানে ৪৮৬ টাকা। একইভাবে কানাডায় আম পরিবহনে প্রতি কেজিতে ৩৩৩ থেকে বেড়ে ভাড়া দাঁড়িয়েছে ৬২৫ টাকায়। বর্তমানে প্রতি কেজি ফল পাঠাতে ইউরোপে ৩৫০-৩৮০ টাকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে ২০০-২২০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। 

আম রপ্তানিকারক ও গ্লোবাল ট্রেড লিঙ্কের স্বত্বাধিকারী রাজিয়া সুলতানা বলেন, ভারত, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো আম রপ্তানিতে আলাদা কার্গো ফ্লাইট ব্যবহার করে, অথচ বাংলাদেশ নির্ভর করে যাত্রীবাহী বিমানের ওপর।  প্যাকিং হাউস করা হয়েছে শ্যামপুরে, পণ্য পাঠাতে হয় বিমানবন্দর থেকে। অথচ দুটো একই জায়গায় হওয়া প্রয়োজন ছিল। এতে খরচ কমত। 

চীনকে আম রপ্তানির নতুন গন্তব্য বানাতে চায় বাংলাদেশ

অন্য দেশে যখন বিমান ভাড়া বেশি, তখন চীনে ফল পাঠাতে ভাড়া দিতে হয় অনেক কম; কেজিতে ৭০-৮৫ টাকা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফরে আম রপ্তানি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে ঢাকা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে চীনও। 

গত ২৮ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার কেন্দুয়া ঘাসুড়া এলাকার একটি রপ্তানিযোগ্য আমবাগান পরিদর্শন করেন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। তখন তিনি বলেছিলেন, ইতোমধ্যে দুই দেশের মধ্যে এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীন বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিযোগ্য কমপক্ষে ১৫ লাখ টন আম নিতে আগ্রহী। 

এদিকে গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, আগামী ২৮ মে চীনে প্রথমবারের মতো প্রায় ৫০ টন আম রপ্তানি করবে বাংলাদেশ। দেশভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে কীভাবে আমের রপ্তানি বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিমান ভাড়া কমানোর লক্ষ্যে কার্গো বিমান ব্যবস্থার বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। 

আম রপ্তানি বাড়াতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ২০২২ সালের জুলাই থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি ‘রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান বলেন, কৃষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। এ বছর এখন পর্যন্ত আম রপ্তা‌নিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। 

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, চীনে ১ লাখ ২০ হাজার টন আম রপ্তানির উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১০টি হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন হবে। ‘ম্যাংগো বোর্ড’ গঠন, নীতিমালা প্রণয়ন, আধুনিক প্রসেসিং সুবিধা, কৃষকের জন্য স্বল্পমূল্যে সোলার প্যানেল বিতরণ, রাজশাহী বিমানবন্দর থেকে কার্গো সুবিধা চালু, কৃষি ইপিজেড গঠন, প্যাকিং হাউস, হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনসহ আম থেকে প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানিতে উদ্যোক্তাদের সহায়তা দেওয়া হবে।

কাতারে ফল রপ্তানিতে বাধা কাটছে

আম রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সম্ভাবনা দেখাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ। সেই লক্ষ্যে আগামী ২৫ জুন সপ্তাহব্যাপী কাতারের রাজধানী দোহারের বাণিজ্য এলাকা খ্যাত সুক ওয়াকিফে ফলমেলার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ দূতাবাস। এতে বাংলাদেশি আম, লিচু ও কাঁঠাল নিয়ে হাজির হবে ৬০টি স্টল। মেলা আয়োজনে সহযোগী পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছে এম্পিরিক রিসার্চ লিমিটেড। 

এম্পিরিক রিসার্চের নির্বাহী পরিচালক সোহেল রানা বলেন, মেলার মাধ্যমে কাতারের সঙ্গে আমসহ অন্য কৃষিপণ্য রপ্তানির নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে। মেলায় কাতারের স্বনামধন্য সব প্রতিষ্ঠান আসবে। ফলে দেশের ব্যবসায়ীদের সেখানকার ক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে।

আরও পড়ুন

×