ঢাকা বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫

সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র

এক দশকে ৪১ প্রাণহানি, সুরক্ষায় উদ্যোগ নেই

এক দশকে ৪১ প্রাণহানি, সুরক্ষায় উদ্যোগ নেই

ফাইল ছবি

 মুকিত রহমানী, সিলেট ও জাকির হোসেন, গোয়াইনঘাট

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫ | ০১:১৪ | আপডেট: ২১ জুন ২০২৫ | ০৮:৫০

সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রে থামছে না মৃত্যুর মিছিল। গত ১১ জুন সর্বশেষ জাফলংয়ে মারা গেছে চট্টগ্রাম বায়েজিদ থানার বাসিন্দা মো. মাহিম (১৬)। এ নিয়ে চলতি বছর চার কিশোরের মৃত্যু হলো। গত এক দশকে জেলার পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে প্রাণ হারিয়েছেন ৪১ জন।

সাঁতার না জানা, চোরাবালি ও পানির তোড়ে ভেসে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই কিশোর-তরুণ। মৃত্যুর মিছিল অব্যাহত থাকার জন্য পর্যটকের অসচেতনতাকে দায়ী করছে পরিচালনা কর্তৃপক্ষ। তবে ভ্রমণপিপাসুদের অভিযোগ, তাদের সুরক্ষায় সংশ্লিষ্টদের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। পর্যটকের জন্য পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করার কথা বিবেচনায় রয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

মাহিমের দাদি সালমা বেগম সমকালকে জানান, দুই নাতি মাহিম-ফাহিমসহ অন্যদের সঙ্গে তিনি জাফলং বেড়াতে আসেন। মাহিম পানিতে ডুবে মারা গেছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘যে এলাকায় মাহিম ডুবে যায়, সেখানে তো কোনো সতর্কতার নির্দেশনা নেই।’

ঈদুল ফিতরের ছুটিতে বেড়াতে এসে জাফলংয়ে মারা যায় সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের বাসিন্দা নয়ন মিয়া (১৭)। গত ৯ জুন ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকায় পানিতে ডুবে প্রাণ হারায় সিলেট সিটি করপোরেশনের লালাদীঘিরপাড়ের জামাল মিয়ার ছেলে মেহেদী হাসান ইমন (১৬)। আর ২ এপ্রিল একই এলাকায় মৃত্যু হয় নগরীর জল্লারপাড় এলাকার এক কিশোরীর।

পাথর, পানি, ঝর্ণার মিশেলে সিলেটের উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র হলো গোয়াইনঘাট উপজেলার জলাবন রাতারগুল, জাফলং, বিছনাকান্দি; কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর, উৎমাছড়া ও জৈন্তাপুরের লালা খাল। এসব কেন্দ্রে সারাদেশ থেকে প্রতিবছর কয়েক লাখ মানুষ বেড়াতে আসেন। সবচেয়ে বেশি আসেন সাদাপাথর ও জাফলংয়ে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কেন্দ্রগুলোর উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয় তদারকি করে। তাদের পক্ষে পর্যটন কেন্দ্রগুলো পরিচালনায় রয়েছে পর্যটন উন্নয়ন কমিটি। জেলা প্রশাসক জেলা কমিটি এবং ইউএনও উপজেলা কমিটির সভাপতি।

ট্যুরিস্ট পুলিশ, প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত এক দশকে জাফলং জিরো পয়েন্ট পর্যটন কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর পর সাদাপাথর এলাকায় ১৫ জন। মৃতদের বেশির ভাগই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। যদিও সিলেট ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত সুপার মতিউর রহমান জানিয়েছেন, ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত আট বছরে তাদের কাছে ৩৩ পর্যটকের মৃত্যুর তথ্য রয়েছে। অধিকাংশ কিশোর-তরুণ সাঁতার জানে না। তারা আনন্দ করতে নেমে জিরো পয়েন্টে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। সতর্ক করতে মাইকিং করা হয়। স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করেন। তার পরও মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না।

স্থানীয়দের ভাষ্যে, মেঘালয় পাহাড় ঘেঁষা জাফলং জিরো পয়েন্টের অনেক স্থান যেন মৃত্যুফাঁদ! রয়েছে অসংখ্য চোরাবালি। আবার সাদাপাথরে স্রোতের পাশাপাশি রয়েছে অনেক গহিন স্থান। বর্ষায় নদীর তীব্র স্রোত, চোরাবালি ও সাঁতার না জানার কারণে সলিল সমাধি হচ্ছে প্রাণের।

পর্যটকদের অভিযোগ, পর্যটন কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণে একক কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এ জন্য দুর্ঘটনা ঘটলে কয়েক দিন পর্যটন উন্নয়ন কমিটির তোড়জোড় চলে। তারা সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড টানিয়ে ও মাইকিং করে দায় সারে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে পুরোনো নৈরাজ্য।

ঢাকা থেকে জাফলং বেড়াতে আসা মাহিন আহমদ সুমন জানান, পর্যটকের নিরাপত্তায় কোনো গাইডলাইন তিনি পাননি। সতর্ক করতে পরিচালনা কর্তৃপক্ষের নেই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। জিরো পয়েন্টে যে যার মতো পানিতে নামে। সেখানে পানির গভীরতা সম্পর্কে বলার মতো কেউ নেই। ফলে বাড়ছে প্রাণহানি।

ট্যুরিস্ট জোন জাফলংয়ের ওসি শাহাদত হোসেন জানান, পর্যটকের সুরক্ষায় উপজেলা প্রশাসন, ট্যুরিস্ট পুলিশ, থানা ও গ্রাম পুলিশ, আনসার, স্কাউট, রোভার স্কাউট, স্টেকহোল্ডার এবং স্বেচ্ছাসেবীরা সার্বক্ষণিক কাজ করছেন। হ্যান্ডমাইকে বারবার সাঁতার না জানলে পানিতে নামতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু নির্দেশনা কেউই মানতে চান না। পর্যটকের অসচেতনতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তিনি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ সমকালকে বলেন, ‘প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্রেই নির্দেশনা টানানো আছে। ট্যুরিস্ট পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীরা পাহারা দেন। দুঃখের বিষয়, বেশির ভাগ পর্যটক এসব তোয়াক্কা করেন না। দুর্ঘটনা এড়াতে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।’

আরও পড়ুন

×