ঢাকা সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪

ইউএনও ওয়াহিদা আক্রান্ত

ঘুরেফিরে চুরির গল্পই

ঘুরেফিরে চুরির গল্পই

সাহাদাত হোসেন পরশ

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১৫:০৬

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার রবিউল ইসলাম ছিলেন একজন পাঁড় জুয়াড়ি। জুয়া খেলে সম্প্রতি অনেক টাকা ঋণগ্রস্ত হন তিনি। এখন পর্যন্ত যে তথ্য মিলেছে তাতে মামলার তদন্ত সংস্থা দিনাজপুরের ডিবি পুলিশের ধারণা, রবিউল একাই ইউএনওর বাসায় হামলা চালান। ইউএনও এবং তার বাবার ওপর হামলার পর ওই বাসা থেকে কিছু টাকাও চুরি করে নিয়েছেন তিনি। রবিউল পরে ওই টাকা যার কাছে রেখেছিলেন, তাকেও আটক করে সাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি নিয়েছে পুলিশ।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশের তদন্ত যে নতুন মোড় নিয়েছে তাতেও উঠে আসছে চুরির ঘটনা। রবিউলকে গ্রেপ্তারের পরই চুরির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। এর আগে বলা হয়েছিল, ঘটনার পর ইউএনওর বাসা থেকে কিছু খোয়া যায়নি। তবে চুরি করার উদ্দেশ্যেই রবিউল সেই রাতে ইউএনওর বাসায় ঢুকেছিলেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে তদন্ত-সংশ্নিষ্টদেরও। তাদের ধারণা, সাসপেন্ড হওয়ার ক্ষোভ থেকেই এ ঘটনা ঘটাতে পারেন তিনি। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র গতকাল এসব তথ্য জানায়।

চুরির দায়ে মাস চারেক আগে ইউএনও কার্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রবিউল সাসপেন্ড হন। তখন ওয়াহিদার অফিস থেকে ৫০ হাজার টাকা চুরি করেন তিনি। সাসপেন্ড হওয়ায় ইউএনওর ওপর ক্ষোভ ছিল তার। অন্যদিকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় হতাশাও কাজ করছিল তার মধ্যে।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সমকালকে জানান, রবিউল স্বীকার করেছেন তিনি একাই সেই রাতে ইউএনওর বাসায় যান। ইউএনওর বাসার মালী থাকায় তার বাসভবনের কোথায় কী রয়েছে তা খুব ভালো করে জানতেন রবিউল। পূর্বপরিচিত হওয়ায় ঘটনার সময় মুখে মাস্ক নিয়ে ঢোকেন তিনি, যাতে ইউএনও ও তার বাবা রবিউলকে চিনতে না পারেন। হামলায় ওয়াহিদার বাবাও আহত হন।

পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ইউএনওর ওপর হামলার তদন্ত প্রায় শেষ। রবিউল দাবি করেছেন, এ ঘটনায় আর কেউ জড়িত নন। বিষয়টি পুলিশ আরও যাচাই করে দেখছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরও দাবি করেন, ইউএনওর বাসার নিরাপত্তা রক্ষী ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। রবিউল এ সুযোগটিই নেন।

পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনার প্রায় সব আলামত পুলিশ জব্দ করেছে। আর রবিউলের তথ্যমতেই অধিকাংশ আলামত পাওয়া যায়।

জব্দ আলামতের মধ্যে রয়েছে- হামলার সময় ব্যবহূত মাস্ক, মই, চাবি, লাল রঙের টি-শার্ট ও হাতুড়ি।

গত বুধবার রাতে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধামাহার গ্রাম থেকে রবিউলকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। তাকে ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। এর আগে ৪ সেপ্টেম্বর র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় স্থানীয় যুবলীগ নেতা আসাদুল হক ও তার দুই সহযোগী নবীরুল ইসলাম ও সান্টু কুমার বিশ্বাস। তখন র‌্যাব দাবি করেছিল, 'গ্রেপ্তার আসাদুল নিজের জড়িত কথা স্বীকার করেছেন। এ ঘটনার মূল আসামি তিনি। পূর্বপরিকল্পিতভাবে চুরির উদ্দেশ্যে তারা ইউএনওর বাসায় ঢুকেছিলেন।'

এখন পুলিশ দাবি করছে, আসাদুল ও তার দুই সহযোগীর কারও এ ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার তথ্য মেলেনি। গ্রেপ্তারের পর তারা র‌্যাবকে 'মিসগাইড' করেছিলেন।

পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, অল্প সময়ের মধ্যেই এই মামলার চার্জশিট দেওয়া সম্ভব হবে। কারণ তদন্তে যেসব প্রশ্ন থাকে তার প্রায় সবগুলোর উত্তর ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে।

এদিকে চিকিৎসকরা জানান, ওয়াহিদার অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নতি হলেও তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন।

'প্রযুক্তিনির্ভর তদন্তে আটক রবিউল': দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, রবিউলকে প্রযুক্তিগত তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিবি। তবে তার পরিবারের দাবি- হামলার ঘটনার সেই রাতে তিনি বাড়িতেই ছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, রবিউলকে গ্রেপ্তার করার আগে তার মোবাইলের নেটওয়ার্ক যাচাই করা হয়েছে। ওই দিন রাতে তার মোবাইলের লোকেশন ছিল ঘোড়াঘাটে। রাতে থাকলেও দিনে সেই লোকেশন আবার ছিল দিনাজপুরে। ধারণা করা হচ্ছে, হামলা করার পর তিনি দ্রুত দিনাজপুরে চলে আসেন তিনি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির ওসি ইমাম জাফর সাংবাদিকদের জানান, 'আমরা যখন রবিউলকে ধরেছি তখন অবশ্যই সায়েন্টিফিক ডকুমেন্ট আমাদের হাতে রয়েছে।'

তিনি জানান, ইউএনওর বাড়ির প্রহরী নাদিম হোসেন পলাশের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দিনাজপুর জেলা সদরের ঝানজিরা গ্রামে বাড়ি পলাশের। ২০০৮ সালে রবিউল চাকরিতে যোগদান করে মালির কাজ করতেন। সেখানে কাজ করতেন পলাশও। পরে পলাশকে ঘোড়াঘাটে বদলি করা হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে ঘোড়াঘাটে বদলি হন রবিউলও। সেখানে চাকরি করার মাস পাঁচেক পরেই টাকা চুরির অপরাধে তাকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে। তাকে ছয় মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। এর মধ্যে চার মাস অতিবাহিত হয়েছে।

জানা গেছে, এরই মধ্যে রবিউলের আরেক ভাই মহসিনকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার গোয়েন্দা পুলিশ তার বাসা থেকে একটি হাঁসুয়া, একটি রড, একটি বাঁশের লাঠি, চারটি প্যান্ট ও চারটি শার্ট নিয়ে যায়। এরপর রবিউলের শ্বশুরবাড়ি থেকে একটি হাতুড়ি নিয়ে গেছে তারা। গতকাল বিকেলে পুলিশ রবিউলের চাকরি জীবনের কাগজপত্র জব্দ করেছে বলে জানান তার ভাই রফিকুল ইসলাম। এ ছাড়া বিরামপুর থেকে গোবিন্দগঞ্জ পর্যন্ত আঞ্চলিক মহাসড়কের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে।

রবিউলের আরেক ভাই সফিকুল ইসলাম বলেন, ৯ সেপ্টেম্বর রাতে রবিউলকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়। পরদিন পুলিশ এসে বাড়িতে হাতুড়ি ও মইসহ যাবতীয় জিনিসপত্রের খোঁজ-খবর করে। পরে তারা জানতে পারেন, ইউএনওর ওপর হামলায় দোষ পড়েছে রবিউলের ওপর। দিনাজপুর থেকে ঘোড়াঘাট প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। সে কখন গেল আর কখন এলো?

ওয়াহিদার বাবাকে ঢাকায় স্থানান্তর: রংপুর অফিস জানায়, ওয়াহিদার বাবা ওমর আলী শেখকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। শনিবার রাতে রংপুর সিটি করপোরেশনের অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালে নেওয়া হয়।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখের কোমরের নিচের অংশ পুরোটাই অবশ হয়ে গেছে। তিনি চলাফেরা করতে পারছেন না। তবে কথা বলতে ও খেতে পারছেন।

হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. তোফায়েল হোসেন ভুঁইয়া জানান, ওমর আলীর ঘাড়ে আঘাত করা হয়েছিল। ফলে তার স্পাইনাল কর্ডে গুরুতর আঘাত লাগে। তার দুটি হাত কিছুটা সচল থাকলেও নাভির পুরো নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। তার দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন।

মানববন্ধন: ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছেন দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। গতকাল সকালে শিক্ষা বোর্ডের প্রধান ফটকের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বক্তব্য দেন সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক রেজাউল করিম চৌধুরী, কর্মচারী ইউনিয়নের সহসভাপতি শহীদুল ইসলাম খান, রিয়াজুল ইসলাম রাজু, আলহামরা পারভীন পিয়া, আরজুমান ফেরদৌস প্রমুখ।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×