ঢাকা বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

টিআইবির গবেষণা

রাজনৈতিকভাবে ঋণখেলাপিদের পৃষ্ঠপোষকতা হচ্ছে

রাজনৈতিকভাবে ঋণখেলাপিদের পৃষ্ঠপোষকতা হচ্ছে

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১২:০০

ব্যাংক পরিচালিত হয় জনগণের অর্থে। তবে এই বাস্তবতার স্বীকৃতি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। জনগণের অর্থ কিছু মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদের মতো ব্যবহার হচ্ছে। তথাকথিত ব্যাংক মালিক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার বিষয়টি ভুলে গিয়ে লুটপাটকারী ও ঋণখেলাপিদের সুযোগ করে দিচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে ঋণখেলাপিদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। আর খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকের কার্যক্রম তদারকিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ব্যাংক খাতের ওপর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে নিরাপদ ব্যাংক খাত প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনসহ ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরে সংস্থাটি।
অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে 'ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ :বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের সমস্যা ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদন প্রণয়নে তার সঙ্গে কাজ করেন সংস্থার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. জুলকার নাইন ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার অমিত সরকার। প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ দুর্বলতার বিভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিদ্যমান আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকেই এক সময় বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করেছে। এই প্রক্রিয়ার ভেতর থেকেই কয়েকজন গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর এবং পরিচালনা পর্ষদ কার্যকরভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনা করেছেন। এখন তা দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর না হলে এর নেতিবাচক প্রভাব সবার ওপরই পড়বে। বিশেষ করে সরকারের ওপর আস্থাহীনতা আরও বাড়বে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করার মতো সুযোগ পাবেন না। আবার আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবের মূলে আছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকার শুধু একাকার হয়নি, তাদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। এর ফলে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের জোরালো অবস্থান ঘোষণা করা হলেও তার প্রয়োগ বা কার্যকর বাস্তবায়ন নেই। এতে করে ব্যাংকিং খাত তথা পুরো অর্থনীতিতে এক অভূতপূর্ব নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। সরকার আমানতকারীদের স্বার্থ না দেখে ঋণখেলাপি, অর্থ আত্মসাৎকারী, জালিয়াতিকারী এবং অর্থ পাচারকারীদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে এখন ৯টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ। এই গ্রুপ ১৪টি প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ব্যাংকের ২৮ শতাংশ এবং ৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে অপর একটি ব্যাংকের ১৪ শতাংশ শেয়ার কেনে। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পরও ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা রদবদলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা গভীর রাত পর্যন্ত অফিসে অবস্থান করেন। একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেন। এর মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি। একাধিকবার যা পুনর্গঠিত ও খেলাপি হয়। এতে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক হলেও সরকারি ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী ও ব্যবস্থাপনা বিষয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রম সীমিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি উপেক্ষা করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগের দৃষ্টান্ত রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গভর্নর নিয়োগে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে অনুসন্ধান কমিটি করা হলেও এখানে সরকারের ইচ্ছায় গভর্নর নিয়োগ হয়। কোনো ধরনের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা না থাকার পরও সাবেক এক অর্থমন্ত্রীর পছন্দের একজনকে মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দুর্বল নেতৃত্ব ও সদিচ্ছার ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনগতভাবে পাওয়া ক্ষমতাও চর্চা করতে পারছে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ করার চেষ্টার নজির থাকলেও নতি স্বীকার না করে পদত্যাগের দৃষ্টান্ত আছে। দুই বছর আগেও পরিদর্শন বিভাগের কর্মকর্তাদের সরাসরি যে কোনো ব্যাংক পরিদর্শনের ক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে ডেপুটি গভর্নরের পূর্বানুমতি নিতে হয়। আবার পরিদর্শন দলের পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিতে পারলেও বর্তমানে ডেপুটি গভর্নরের অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে হয়। এসব কারণে এখন ব্যাংকিং খাতের অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি ও জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটনে বিলম্ব হয়।
এতে আরও বলা হয়, অনেক ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দু-একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর যোগসাজশের মাধ্যমে পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখিত অনিয়ম চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে বাদ দেওয়া হয়। তদারকি কাজে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের একাংশ আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে প্রকৃত তথ্য গোপন করে দুর্বল তদন্ত প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন। চাকরির মেয়াদ শেষে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ে নিয়োগের আশায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাংশ প্রভাবশালীদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকে। অনেক সময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তা এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা হয়। তবে আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বারবার পুনর্গঠিত ও পুনঃতফসিল এবং উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ এবং অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে প্রকৃত পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ কমাতে নানা কৌশলের পরও গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।
টিআইবির সুপারিশ হলো, খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বেসরকারি প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সব ধারা সংশোধন বা বাতিল করতে হবে। অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে গঠিত প্যানেলের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া আদালতের স্থগিতাদেশ পাওয়া খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ, পুনঃতফসিল করে বারবার খেলাপি হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ, পরিদর্শক দলকে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া এবং তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।




আরও পড়ুন

×