ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

বিক্ষোভ সমাবেশ মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালিত

ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে উত্তাল দেশ

ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে উত্তাল দেশ

ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনসহ সকল সহিংসতার বিরুদ্ধে শনিবার বিকেলে সংসদ ভবনের সামনে মানববন্ধন করা হয়-ফোকাস বাংলা

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২০ | ১০:১০

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে গৃহবধূর ওপন যৌন নির্যাতনসহ সারাদেশে নারী ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা এবং বীভৎস নির্যাতনের বিচারের দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ গোটা দেশ শনিবারও উত্তাল ছিল। এদিন রাজধানীর শাহবাগ, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ষষ্ঠ দিনের মতো বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন দল ও সংগঠন। এসব কর্মসূচি থেকে ধর্ষক ও নির্যাতকদের গ্রেপ্তার, দ্রুত বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে।

রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে 'ধর্ষণের বিরুদ্ধে ক্রোধ' প্রকাশ করেছেন হাজারো মানুষ। 'প্রজন্মান্তরে নারীবাদী মৈত্রী'র কর্মীরা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে অবস্থান নেন। যৌন সহিংসতাকে জাতীয় জরুরি অবস্থা বলে ঘোষণা দেওয়া হয় অবস্থান কর্মসূচি থেকে। এ সময় বিনা অনুমতিতে যে কোনো যৌনকর্মকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে ধর্ষণের সংজ্ঞা সংশোধনসহ ১০ দফা দাবি জানানো হয়।

বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠনের সঙ্গে অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেন কয়েকশ শিক্ষার্থী। প্রথাবহির্ভূতভাবে আয়োজিত এ অবস্থান কর্মসূচিতে কোনো বক্তা ছিলেন না। সবাই একযোগে স্লোগানে স্লোগানে ধর্ষকের বিচার, নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান। এ সময় নিপীড়নবিরোধী ছবি ও প্ল্যাকার্ড আঁকা হয়। বাদ্য বাজিয়ে 'রাষ্ট্র ও পরিবারে সমান হবো অধিকারে', 'না মানে, না' ফেস্টুন প্রদর্শন করেন অবস্থানকারীরা।

'ধর্ষণের বিরুদ্ধে ক্রোধ' প্রকাশে বিকেল ৩টা থেকে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে বিক্ষোভকারীরা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জমায়েত হন। পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়, প্রশাসনের অনুমতি না থাকায় সংসদের সামনে সভা-সমাবেশ করা যাবে না। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা অবস্থান কর্মসূচি পালনে অনড় থাকেন। তাদের তরফ থেকে বলা হয়, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তারা যে কোনো স্থানে শান্তিপূর্ণভাবে জমায়েত হওয়ার অধিকার রাখেন। তারা সমাবেশ করবেন না। শুধু ধর্ষণের বিরুদ্ধে তাদের ক্রোধ জানাবেন। 

পরে পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যেই জমায়েত হন বিক্ষোভকারীরা। গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আলোকচিত্রী শহিদুল আলমসহ বিশিষ্ট নাগরিকরাও তাদের সঙ্গে অবস্থান নেন। নারী পক্ষের প্রতিষ্ঠাতা শিরিন হক ১০ দফা দাবি তুলে ধরে বলেন, মৃত্যুদণ্ড কোনো সমাধান নয়। ধর্ষণের সংস্কৃতি সমূলে উৎপাটন চান তারা।

উত্তাল প্রেস ক্লাব এলাকা: নারী ও শিশু ধর্ষণ-নির্যাতনের প্রতিবাদে উত্তাল ছিল জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকা। বিভিন্ন সংগঠন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সকাল থেকে বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। তাদের দাবি ছিল, ধর্ষণের ঘটনা দ্রুততার সঙ্গে আমলে নিয়ে বিচার করতে হবে। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ধর্ষণ ও লুটপাটের প্রতিবাদে বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ) আয়োজিত মানববন্ধনে নেতারা বলেন, দেশে সন্ত্রাস ও ব্যভিচারবিরোধী গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। এটা দমনের চিন্তা কেউ যেন না করে। ধর্ষকদের উপযুক্ত বিচার না হলে জনগণ মানবে না। মুখে 'জিরো টলারেন্স' বলে বাস্তবে আপস করলে সরকার জিরো হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ জাসদ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবদুস সালাম খোকনের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, কেন্দ্রীয় নেতা করিম সিকদার, মনজুর আহমেদ মনজু, আনোয়ারুল ইসলাম বাবু, নাসিরুল হক নওয়াব, আসাদুজ্জামান জাকির, মহিউদ্দিন আহম্মদ, আশফাকুর রহমান সবুজ, ফারুক হোসেন চঞ্চল, সোলেমান দেওয়ান, শাহজাহান আলী সাজু, মাহফুজুর রহমান রাহাত, গৌতম শীল প্রমুখ।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ধর্ষণের প্রতিবাদে আরও বিক্ষোভ করেছে ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, আওয়ামী ওলামা লীগ, মইনীয়া যুব ফোরাম, জাতীয় মহিলা পার্টি, জাতীয় যুব সংহতি এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংগঠন।

আরও প্রতিবাদ: রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ধর্ষক, স্বাস্থ্য খাতসহ সব ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ ও রাষ্ট্রীয় লুটেরাদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে জাতীয় যুব জোট। এ সমাবেশ থেকে ধর্ষকদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও তিন মাসের মধ্যে বিচার শেষ করে প্রকাশ্য দিবালোকে উন্মুক্ত স্থানে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে রায় কার্যকরের দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে ধর্ষকের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নির্যাতিতাকে প্রদান করার বিধান রেখে আইন সংস্কার করার দাবিও জানান নেতারা।

জাতীয় যুব জোটের সভাপতি রোকনুজ্জামান রোকনের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম, সাইফুজ্জামান বাদশা, শরিফুল কবির স্বপন, সাব্বাহ আলী খান কলিন্স, কাজী সালমা সুলতানা, আশিফুর রহমান বাবু, প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ সুমন, সামছুল ইসলাম সুমন, পারভেজ আক্তার শিল্পী, রাশিদুল হক ননি, রেশমা হাবিব প্রমুখ।

সারাদেশে নানা কর্মসূচি: রাজশাহী ব্যুরো জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে রাজশাহীতে কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন। সরকার ধর্ষণ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে ও ধর্ষকদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না করলে সংগঠনগুলো ধারাবাহিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে।

শনিবার নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে পঞ্চম দিনের মতো গণস্বাক্ষর ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধনে ছাত্রনেতা তামিম সিরাজী, আল রশিদ রাহী, মন্দিরা ঘোষ প্রমুখ বক্তব্য দেন। জিরো পয়েন্টে নারী মুক্তি সংসদ রাজশাহী জেলা শাখা মানববন্ধন-সমাবেশ করে। নারী মুক্তি সংসদের জেলা শাখার সভাপতি তসলিমা খাতুনের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন দেবাশিষ প্রামাণিক দেবু, নাজমুল করিম অপু, মনিরুজ্জামান মনি, অঞ্জনা সরকার প্রমুখ। এ ছাড়া নারী ও শিশু অধিকার ফোরামের মানববন্ধনে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও মহানগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বক্তব্য দেন।

এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যায় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী রাজশাহী জেলা সংসদ নগরীর আলুপট্টি মোড়ে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ করে। উদীচী জেলা সংসদের সভাপতি অধ্যক্ষ জুলফিকার আহমেদ গোলাপের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অজিত কুমার মণ্ডলের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন প্রশান্ত কুমার সাহা, অধ্যক্ষ রাজকুমার সরকার, শাজাহান আলী বরজাহান, সেলিনা বানু, প্রশান্ত মিনজ প্রমুখ।

খুলনা ব্যুরো জানায়, পিকচার প্যালেস মোড়ে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে দু'দিনব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। নারী ও শিশু অধিকার ফোরাম খুলনা মহানগর শাখা কর্মসূচির আয়োজন করে।

সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটেও বিভিন্ন সংগঠন নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। সমকাল সুহৃদ সমাবেশ সিলেট জেলা কমিটি ছাড়াও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলার মুখ সিলেট, গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়ন, দুস্কাল প্রতিরোধে আমরাসহ কয়েকটি সংগঠন মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও সমাবেশ করে।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে প্রতিবাদী মানববন্ধন করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি চট্টগ্রাম জেলা শাখা। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করাসহ বিভিন্ন দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য দেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক শওকত বাঙালি।

কিশোরগঞ্জে ধর্ষকদের ফাঁসির দাবিতে শহরের নজরুল ইসলাম চত্বরে সুশাসনের জন্য নাগরিকের উদ্যোগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। পাবনা শহরের সাংস্কৃতিক চত্বরে ধর্ষণবিরোধী সমাবেশ, আলোচনা সভা ও গণসংগীত অনুষ্ঠান করেছে প্রত্যাশা, ব্রেড, পিসিডি, জনহিতৈষী সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। প্রত্যাশার নির্বাহী পরিচালক আব্দুল বাতেন রুশদীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সালফী আল ফাত্তাহ, সাংবাদিক এবিএম ফজলুর রহমান প্রমুখ।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দীর্ঘ মানববন্ধন ও প্রতিবাদ র‌্যালির আয়োজন করে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। এ সময় বক্তারা বলেন, ধর্ষক কোনো দলের হতে পারে না। ধর্ষকের পরিচয় সে ধর্ষক।

ময়মনসিংহ জেলা সমকাল সুহৃদ নগরীর টাউন হল মোড়ে মানববন্ধন করে ধর্ষণকারীদের ফাঁসি দাবি করে। ভোলায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করে সুজন ভোলা জেলা কমিটি। তাদের স্লোগান ছিল 'সচেতন, সংগঠিত ও স্বোচ্ছার জনগোষ্ঠীই গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ'।

এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। দিনাজপুরের পার্বতীপুরে আদিবাসী সাঁওতালদের উদ্যোগে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পটুয়াখালীতে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে চারটি মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সামনে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে জেলা নাগরিক ফোরাম।

মেহেরপুরের গাংনীতে ছাত্রলীগের উদ্যোগে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। দেশব্যাপী সংঘটিত নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ এবং ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রংপুরের মিঠাপুকুরে মানববন্ধন করেছে মিঠাপুকুর ছাত্র উন্নয়ন পরিষদ।

ঝিনাইদহের শৈলকূপায় শহরের চৌরাস্তা মোড়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করে ঘরে-বাইরে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জোর দাবি জানান। সুনামগঞ্জের ছাতকে কেশুর গ্রুপ টুরের উদ্যোগে জাউয়াবাজারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। লক্ষ্মীপুরে সুজনও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এছাড়া বগুড়ার শেরপুর, ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, পাবনার ঈশ্বরদী, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়।

আরও পড়ুন

×