ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

বিজয়ের মাস

'বীরের কণ্ঠে বীরগাথা' সংরক্ষণ হয়নি এখনও

'বীরের কণ্ঠে বীরগাথা' সংরক্ষণ হয়নি এখনও

একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়োল্লাস - সংগৃহীত

আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০

একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বীর বাঙালি যে যেভাবে পেরেছে, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশকে স্বাধীন করতে। তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে যুদ্ধের বীরত্বগাথা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে 'বীরত্বগাথা' বা 'স্মৃতিচারণ' সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। চূড়ান্ত হয়নি তাদের তালিকাও। অথচ সময়ের স্রোতে একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধা। খবরের কাগজে প্রায়ই আসছে তাদের মৃত্যুর খবর। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ দশকে প্রায় ৫০ ভাগ গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাই প্রয়াত হয়েছেন।
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য ১৯৭১ সালে বয়স কমপক্ষে সাড়ে ১২ বছর হতে হয়। সে হিসেবে বর্তমানে স্বীকৃতি পাওয়া কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার বয়সও প্রায় ৬৩ বছর। মুক্তিযুদ্ধ গবেষকসহ বিভিন্ন মহল থেকেও গত এক দশকে মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। একপর্যায়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এক অনুষ্ঠানে 'বীরের কণ্ঠে বীরগাথা', অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা তাদেরই কণ্ঠে ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে সরংক্ষণের ঘোষণা দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। পরে এ বিষয়ে প্রকল্প প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সে উদ্যোগ এখনও প্রস্তুতিপর্বেই থমকে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকা প্রণীত না হওয়ায় প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণসহ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেনি মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবনী ও সব ভাষণ ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে সংরক্ষণেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি; বরং তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে কাজ চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়সহ তিনটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে তার বীরত্বগাথা তুলে ধরা গেলে সেটি হবে অত্যন্ত ইতিবাচক। এতে তারা বীরত্বগাথার পাশাপাশি পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের অত্যাচার-নির্যাতনের কথাও জানতে পারবে। ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরও বিকৃতি হবে না। এরই মধ্যে আমরা প্রবীণ অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হারিয়ে ফেলেছি। ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের মধ্যে জীবিত আছেন মাত্র দু'জন। তাই দ্রুত 'বীরের কণ্ঠে বীরগাথা' সংরক্ষণের কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি চার শ্রেণিতে বীরত্বসূচক খেতাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পরে ১৯৭৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর ৬৭৬ জনকে খেতাব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পদমর্যাদায় সাতজনকে বীরশ্রেষ্ঠ, উচ্চ পদমর্যাদায় ৬৮ জনকে বীরউত্তম, প্রশংসনীয় পদমর্যাদায় ১৭৫ জনকে বীরবিক্রম ও ৪২৬ জনকে বীরত্বসূচক প্রশংসাপত্রের খেতাব বীরপ্রতীকে ভূষিত করা হয়। খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে দু'জন নারী ও পাঁচজন অবাঙালি বীরত্বসূচক খেতাব পান, যাদের মধ্যে একজন বিদেশিও রয়েছেন। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে এসে খেতাব পাওয়া এসব মুক্তিযোদ্ধার অধিকাংশই প্রয়াত। কতজন মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন, সে তথ্যও নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, "ধারণা করছি, দেশে সোয়া লাখ মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন। তাদের 'ভিডিও ইন্টারভিউ' আগামী প্রজন্মের জন্য সংগ্রহ, সম্প্রচার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ মন্ত্রণালয় অনেক আগেই নিয়েছিল। কিছু সমস্যার কারণে এগোয়নি। আশা করছি, আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের কাজ শেষ হবে। এরপর আগামী বছরেই যাতে 'বীরের কণ্ঠে বীরগাথা' প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়, সেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।"
বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, 'এটি তথ্য মন্ত্রণালয় অনেক আগে থেকেই করছে। একই কাজ কয়েক মন্ত্রণালয়ের করার প্রয়োজন নেই। এ জন্য আমরা তথ্য মন্ত্রণালয় থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ এ-সংক্রান্ত ডকুমেন্টস সংগ্রহ করে ব্যবহার করছি।' তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচারের বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কিনা- এমন প্রশ্নে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, জনবল সংকটসহ অনেক কারণেই এটি হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তার আদর্শ প্রচারে দীর্ঘমেয়াদি কিছু কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
চূড়ান্ত হয়নি মুক্তিযোদ্ধার তালিকাও :মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল এক লাখ সাত হাজার, অর্থাৎ মোট এক লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জন। সেক্টর থেকে পাওয়া (মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর বিলুপ্তির পর এসব দলিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তর করা হয়েছে) দলিলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন। বাকি ৬০ হাজার ৯০৪ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ছয়বার তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে, যা এখনও অসম্পূর্ণ। বর্তমানে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ ৩৮ হাজার ৩৭৮ জন। সর্বশেষ ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট আমলে গেজেটে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ওই তালিকা যথাযথভাবে সংশোধনের পাশাপাশি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হননি- এমন মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিতে আবেদন নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এর যাচাই-বাছাই এখনও অব্যাহত রয়েছে। অবশ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দুই লাখ ৩৮ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থাকলেও ডিজিটাল ডাটাবেজের আওতায় এসেছেন এক লাখ ৭২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা। ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্তির কার্যক্রম এখনও অব্যাহত আছে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদর চূড়ান্ত তালিকা স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও হয়নি। এটি লজ্জার। আমলাদের কারণেই এটি হয়নি। দ্রুত এ তালিকা নিয়ে অপেক্ষার অবসান হওয়া প্রয়োজন।'
বেসরকারি পর্যায়ে অনন্য উদ্যোগ :মুক্তিযোদ্ধাদের স্বকণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগ না থাকলেও বেসরকারি উদ্যোগে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করেছেন। যার সংখ্যা খুব বেশি না হলেও এগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের অনন্য দলিল হিসেবে কাজ করছে। সমকালের অনুসন্ধানে জানা যায়, কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গত বছর সংরক্ষণ করা হয়েছে ওই জেলার দুই হাজার ৭৩০ জন জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধার দুই হাতের ছাপসহ তাদের তথ্য এবং এক হাজার ৫৭১ জন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার তথ্যসহ মোট চার হাজার ২৭৩ মুক্তিযোদ্ধার তথ্যাদি। সুলতানা পারভীন জানান, প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠ থেকে যুদ্ধের বর্ণনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই এসব তথ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মোবাইল অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণফোন ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার স্বকণ্ঠে ভিডিও ক্লিপসে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়, যা এখনও অব্যাহত আছে। এ ছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগেও মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু যুদ্ধস্মৃতি সংগ্রহের পর তা ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়েছে, যা ইতিহাসের অনন্য দলিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, 'আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করব। তাদের কাছ থেকেও ডকুমেন্টসগুলো সংগ্রহ করা হবে।'


whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×