ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

স্বপ্ন ছুঁয়েছে এপার-ওপার

স্বপ্ন ছুঁয়েছে এপার-ওপার

তিন বছর দুই মাস দশ দিনের মাথায় এলো সেই স্বপ্নের দিন। বৃহস্পতিবার সেতুতে শেষ স্প্যান বসানোর পর প্রমত্ত পদ্মার দুই পাড়ে রচিত হলো সেতুবন্ধ - মাহবুব হোসেন নবীন

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০

যেন এক নতুন সূর্যোদয় হলো সোনারোদ ছড়িয়ে। কেটে গেল কুয়াশার ঘোর। দিগন্তে ছড়িয়ে গেল স্বপ্নপূরণের আনন্দরেণু। এক মহাকর্মযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে অবশেষে মাথা তুলে দাঁড়াল স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যুক্ত হলো প্রমত্ত পদ্মার এপার-ওপার।
পদ্মা সেতুর ৪১তম, অর্থাৎ শেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দেশের সবচেয়ে বড় এই অবকাঠামোর মূল অংশ দৃশ্যমান হলো। এ উপলক্ষে সেতু এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দেশের অন্যত্রও মানুষের মধ্যে দেখা দেয় উদ্দীপনা। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, পদ্মার তীব্র স্রোত, এমনকি চলমান মহামারিও বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই স্বপ্নের সেতু নির্মাণের পথে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহস করে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে হাত দেন। সরকারের অপরিসীম চেষ্টায় সব বাধা পেরিয়ে সেতুর মূল কাজ শুরুর ছয় বছরের মাথায় এসে শেষ হলো স্প্যান বসানো। অর্থাৎ সেতুর গুরুত্বপূর্ণ বড় কাজ শেষ হলো গতকাল। এখন শুধু অপেক্ষা দেশের বৃহত্তম এই সেতুর স্প্যানের ওপর গাড়ি ও রেল চলাচলের স্ল্যাব বসানো।
সরকার আশা করছে, ২০২১ সালের বিজয় দিবসের আগেই তা শেষ হবে। এরপর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সারাদেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। তবে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, ২০২২ সালের জুনের মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেওয়া সম্ভব হবে। এরই মধ্যে ভায়াডাক্ট, অর্থাৎ মূল নদীর বাইরে পিলার ও স্প্যান বসানো, সংযোগ সড়ক, নদীশাসনের কাজ শেষ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মা সেতুর এই অগ্রগতি সরকারের আস্থা ও সাহসের প্রতীক। বাংলাদেশ যে চাইলে বড় কিছু করে দেখাতে পারে- তা প্রমাণিত হলো। এতদিন পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকার মনোযোগ দিয়েছে। এখন এই সেতুকে ভিত্তি করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে বাড়ানো যায়, সে কাজ করতে হবে।
স্প্যানের শুরু থেকে শেষ :স্বপ্নের এই সেতুতে প্রথম স্প্যান বসেছিল ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। গতকাল বসল সর্বশেষ স্প্যান। ৪১টি স্প্যান বসাতে তিন বছর দুই মাস ১০ দিন লাগল। করোনাভাইরাস মহামারি এবং পদ্মার অত্যধিক স্রোত স্প্যান বসানোর কাজে গতি কমিয়ে দেয়।
তবে গত ১১ অক্টোবর ৩২তম স্প্যান বসানোর পর অনুকূল আবহাওয়া পাওয়া যায়। কারিগরি কোনো জটিলতাও তৈরি হয়নি। ফলে বাকি স্প্যানগুলো দ্রুত বসানো সম্ভব হয়। এই স্প্যানই সেতুর মূল অবকাঠামো। পিলারের ওপর বসানো হয়েছে এগুলো। এর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন, আর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। যানবাহন ও ট্রেন চলাচলের রাস্তা নির্মাণের জন্য স্প্যানের ওপরে ও নিচে স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। এসব স্প্যান চীনে তৈরি করে জাহাজে করে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়েছে। ৪২টি পিলারের সঙ্গে স্প্যানগুলো জোড়া দেওয়ার মাধ্যমে পুরো সেতু দৃশ্যমান হয়েছে।
মূল পদ্মা সেতুর, অর্থাৎ নদীর অংশের দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তবে ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য হবে ৯ কিলোমিটারের কিছু বেশি। নদীর দু'পাশের অংশের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। পুরো কাজ শেষ হলে যানবাহন চলাচলের পথটি হবে ২২ মিটার চওড়া, চার লেনের। মাঝখানে থাকবে সড়ক বিভাজক। স্প্যানের ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতুতে একটিই রেললাইন থাকবে। তবে এর ওপর দিয়ে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ দুই ধরনের ট্রেন চলাচলেরই ব্যবস্থা থাকবে। ভায়াডাক্টে এসে যানবাহন ও ট্রেনের পথ আলাদা হয়ে মাটিতে মিশেছে।
২২ বছরের যাত্রা :১৯৯৮ সালে সরকারের তহবিলে প্রথম এই সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জাপানের সংস্থা জাইকার অর্থায়নে এর সম্ভাব্যতা পুনরায় যাচাই করা হয়। এরপর ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। এরপর অর্থায়নে এগিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক; কিন্তু কিছুদিন পরই বিপত্তি দেখা দেয়। এতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সংস্থাটি প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। ফলে সেতুর ভবিষ্যৎ শঙ্কায় পড়ে যায়। এরপর সরকার এই সেতু নির্মাণে বিকল্প অর্থায়নের জন্য মালয়েশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে। এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক পুনরায় ফিরে আসে অর্থায়নের জন্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে এর বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন।
প্রকৌশলের বিস্ময় :প্রকৌশলীরা বলেছেন, পদ্মার বুকে সেতু গড়ে তোলার ধারণাটিই ছিল বিস্ময়কর। কেননা, পদ্মার নদীতলের মাটি এতই পরিবর্তনশীল যে, মুহূর্তে যে কোনো স্থান থেকে যে পরিমাণ মাটি সরে যায়, তাতে ২১ তলা উঁচু ভবনের উচ্চতার সমপরিমাণ গভীরতার খাদ তৈরি হয়। এমন একটি স্থানে পাইলিংয়ের মাধ্যমে খুঁটি স্থাপনের মতো বিশাল এক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে পদ্মা সেতুর প্রকৌশলীদের। বিশেষ পদ্ধতিতে শেষ পর্যন্ত পাইলিং করতে হয়েছে। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ হচ্ছে। প্রকৌশলীরা জানান, নদীর পানি থেকে প্রায় ১৮ মিটার উঁচু পদ্মা সেতুর তলা। পানির উচ্চতা যতই বাড়ূক না কেন, এর নিচ দিয়ে পাঁচতলার সমান উচ্চতার যে কোনো নৌযান সহজেই চলাচল করতে পারবে।
কাজ যেভাবে এগিয়েছে :মূল সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। কাজ পায় চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। তাদের সঙ্গে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকার চুক্তি হয়। চার বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কাজ শুরুর পরের বছরই মাওয়ায় স্থাপিত নির্মাণ মাঠের বেচিং প্লান্টসহ একাংশ নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। ২০১৭ সালে প্রতিটি খুঁটির নিচে মাটি পরীক্ষায় ২২টি খুঁটির নিচে নরম মাটি পাওয়া যায়। তখন নকশা সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফেরিঘাট স্থানান্তরেও সময় লেগে যায়।
শুরুতে প্রতিটি খুঁটির নিচে ছয়টি পাইল (মাটির গভীরে স্টিলের ভিত্তি বসানো) বসানোর পরিকল্পনা ছিল। যুক্তরাজ্যের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নকশা সংশোধন করে একটি করে পাইল বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। এ জন্য খুঁটি নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হতে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত লেগে যায়। সব মিলিয়ে এই কাজে প্রায় এক বছর বাড়তি লাগে। এ জন্য মাঝে কাজে কিছুটা গতি হারায়। ঠিকাদারকে দুই বছর আট মাস বাড়তি সময় দেওয়া হয়। নভেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর ৯১ শতাংশ কাজ শেষ হয়। নদীশাসন কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭৬ ভাগ।
ব্যয় ও সেতুর প্রভাব :২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিস্তারিত সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয় জাপানের দাতা সংস্থা জাইকা। ২০০৭ সালে একনেকে পাস হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। পরের বছর নকশা চূড়ান্ত ও অনুমোদন পায়।
২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এরপর প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন না করে ২০১৮ সালের জুনে আবারও ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। গত ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি।
এই সেতু নির্মাণের ফলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে জিডিপি বাড়বে বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। আর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু অর্থনীতিতে যেমন প্রভাব ফেলবে, তেমনি সহজ হবে মানুষের চলাচলও।
এখনও যেসব কাজ বাকি :পদ্মা সেতু প্রকল্পের বেশ কিছু কাজ এখনও বাকি। সেতুতে রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো এখনও শেষ হয়নি। স্ল্যাব বসাতে হবে দুই হাজার ৯১৭টি। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত এক হাজার ৩৩৩টি স্থাপন করা হয়েছে। রেলওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজও চলছে। রেললাইনের দুই হাজার ৯৫৯টি স্ল্যাবের মধ্যে এক হাজার ৯৪২টি এর মধ্যেই স্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ সেতুতে প্রায় তিন কিলোমিটার চার লেনের সড়ক ও চার কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনের কাজ শেষ। তবে সব স্ল্যাব বসানো হলেই রেল চালু করা যাবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট করে বলছেন না কেউ।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার দিনই মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল চলবে। বাকি অংশ পরে হবে। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে মোট ৪৮৪টি সুপার টি গার্ডার স্থাপন করতে হবে। এর মধ্যে ৩২১টি স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্রিজের রেলিং, স্ট্রিট ও আর্কিটেকচারাল লাইটিং, গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করতে হবে।
উৎসবমুখর পরিবেশ :সমকালের মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু জানান, সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন 'তিয়ান ই'র মাধ্যমে এই স্প্যান বসানোর কাজ শুরু হয়। করোনার কারণে শেষ স্প্যান বসানো উপলক্ষে বিশেষ কোনো আয়োজন ছিল না। তবে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। সকাল থেকেই নদীতে ও নদীর পাড়ে সাধারণ মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। ছিলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
অনেকেই নৌকা, ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে চলে আসেন নদীর ভেতরে স্প্যান বসানোর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের কাছে। তবে কর্তৃপক্ষ সাধারণ মানুষকে এ সময় সরিয়ে দেয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্প্যান নিয়ে ভাসমান ক্রেন পিলারের কাছে পৌঁছে যায়। তারপর পিলারের ওপর স্প্যানটি বসানোর কাজ শুরু হয়। দুপুর ১২টার দিকে সর্বশেষ স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়।
এ সময় মূল সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ আবদুল কাদের বলেন, ৪১তম স্প্যান জোড়া লাগানোর মাধ্যমে পদ্মার দুই পাড় যুক্ত হলো। স্বপ্ন আজ সত্যি হলো। এ সময় ঘটনাস্থলে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ স্প্যানটির এক পাশে টাঙানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। অন্য পাশে চীনের পতাকা। স্প্যানটি নিয়ে ভাসমান ক্রেন যখন পিলারের দিকে রওনা দেয়, তখন উপস্থিত কর্মকর্তাসহ সবাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সঙ্গে নিয়ে কর্মকর্তারা ছবি তোলেন।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×