সমৃদ্ধির হাতছানি কাজুবাদামে

জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ০৪:০২
পাহাড়িদের কাছে খুব সাধারণ পণ্য ছিল কাজুবাদাম। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক ছোট কাগজ 'মাওরুম'-এর সম্পাদক দীপায়ন খীসা শোনালেন পুরোনো গল্প। পাহাড়ের কোলে বেড়ে ওঠা বান্দরবানের এই আদিবাসী তখন পড়তেন পঞ্চম শ্রেণিতে। ঘরের পাশেই ছিল কাজুবাদামের গাছ। নজরকাড়া এই ফল যখন পেকে লাল হতো, তখন সেই খোসা তুলে লবণ ও মরিচ মিশিয়ে খেতেন। বেশ সুস্বাদু ছিল কাজুবাদামের ওপরের এই অংশ। কিন্তু লাল অংশের ভেতরে বাদাম যে এতটা মূল্যবান, তা দীপায়ন খীসা জেনেছেন বড় হয়ে। পাহাড়িদের কাছে ফেলনা সেই কাজুবাদামেই এখন সমৃদ্ধির হাতছানি দেখছেন উদ্যোক্তারা। চাষে আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা। পার্বত্য এলাকা ছেড়ে চাষাবাদ বিস্তৃত হচ্ছে অন্য এলাকায়ও। গড়ে উঠছে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। বাড়ছে উদ্যোক্তা। অভ্যন্তরীণ ব্যাপক চাহিদা মিটিয়েও কাজুবাদাম রপ্তানি করে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালক মো. কবির হোসেন বলেন, সনাতন কৃষি থেকে বের হয়ে আধুনিক কৃষির সাম্রাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। প্রাথমিক অবস্থায় পাহাড়ি অঞ্চলে কৃষি পুনর্বাসন কার্যক্রমের সঙ্গে ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস ঠেকাতে কাজুবাদাম গাছ লাগানো হয়। বর্তমানে গাছটি দ্রুত বর্ধনশীল, পরিবেশবান্ধব ও লাভজনক হওয়ায় পাহাড় এবং সমতল জমির পতিত জায়গায় রোপণ হচ্ছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কাজুবাদামের স্থান তৃতীয়। আমাদের দেশের জলবায়ু কাজুবাদাম চাষের বেশ সহায়ক।
সংশ্নিষ্টরা জানান, বছর পাঁচেক আগেও কাজুবাদামের বিক্রি, বাজারজাত বা প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা ছিল না। শুধু রাঙামাটিতে দেশীয় পদ্ধতিতে কিছু প্রক্রিয়াজাত হতো। দাম না পেয়ে একসময় কাজুবাদামের গাছ কেটে ফেলেছিলেন পাহাড়ের অনেক কৃষক। ২০১০ সালে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদ তানভীরের চোখে পড়ে এই বাদাম। ২০১০-১১ অর্থবছরে কাঁচা কাজুবাদামের একটি চালান রপ্তানির পরই কদর পেতে থাকে এটি। ২০১৬ সালের জুনে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ডেইলপাড়ায় 'গ্রিনগ্রেইন কেশিও প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি' নামে কারখানা গড়ে তোলেন শাকিল। শুরুতে মাত্র ১০ জন কর্মী নিয়ে কাজ শুরু করলেও এখন কারখানায় কাজ করছেন ৬৫ জন। দেশ থেকে প্রথমবারের মতো রপ্তানিও হচ্ছে এই কারখানার বাদাম। শাকিল আহমেদের সাফল্য দেখে দেশে কাজুবাদামের কারখানা করেছেন আরও ছয়জন। নীলফামারীতেও ব্যক্তি উদ্যোগে দুটি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা হয়েছে।
এতে চাষে আগ্রহী হচ্ছেন কৃষক। বান্দরবানসহ পার্বত্য এলাকায় এখন চাষ হচ্ছে এই বাদামের। কৃষি মন্ত্রণালয় আবাদ বাড়াতে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিচ্ছে। প্রক্রিয়াজাত কারখানার উদ্যোক্তাদের নীতিসহায়তাও দিচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, পার্বত্য এলাকার পাশাপাশি বরেন্দ্র অঞ্চলেও কাজুবাদাম চাষের প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশে পাঁচ লাখ হেক্টর কাজুবাদাম চাষ উপযোগী জমি রয়েছে, এর বেশির ভাগ পার্বত্য এলাকায়। দুই হাজার হেক্টর জমিতে কাজুবাদামের চাষাবাদ শুরু করা গেলে দেশে কাজুবাদামের উৎপাদন পাঁচ লাখ টনে দাঁড়াবে। এই মুহূর্তে বান্দরবানে এক হাজার ৭৯৭ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। ২০১৮ সালে যেখানে দেশে ৯১৬ টন ফলন হয়, সেখানে ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৩২৩ টনে। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে ফলন বেড়েছে ৩২ শতাংশ।
কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, বর্তমানে বিশ্বে মোট ৫৯.৩০ লাখ টন কাজুবাদাম উৎপাদিত হয়। কাজুবাদামের বাজার ৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; এর মধ্যে ভিয়েতনাম একাই ৩ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে। কিন্তু সেই দেশে কাজুবাদাম উৎপাদন হয় পাঁচ লাখ টন; আরও ১৫ লাখ টন তারা আমদানি করে আনে। কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির পর দেশে প্রক্রিয়াজাত এবং রপ্তানি করে ভিয়েতনাম বিশ্ববাজারে এখন শীর্ষে।
ভিয়েতনাম মডেলের উদাহরণ টেনে উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদ বলেন, কাঁচা কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক্কহার শূন্য করে দিয়ে দেশে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানির মাধ্যমেই ভিয়েতনামের শুরু। ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি কম। ২০২৪ সালের মধ্যে বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমাদের বছরে চার লাখ ৪৪ হাজার টন কাজুবাদাম প্রয়োজন হবে। উৎপাদন না বাড়া পর্যন্ত বাকি কাজুবাদাম কাঁচা আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হবে। এরপর দেশের কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে সেটি আমরা রপ্তানি করব। আমাদের স্বপ্ন ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম কাজুবাদাম রপ্তানিকারক দেশ হওয়া।
উদ্যোক্তারা জানান, কাঁচা কাজুবাদাম আমদানিতে বর্তমানে বাংলাদেশে কাস্টমস শুল্ক্ক ৫৮ থেকে ৮৯ শতাংশ। ভারতে আমদানি এই শুল্ক্ক আড়াই শতাংশ এবং ভিয়েতনামে শূন্য শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি হয় মাত্র ১৭ টন। আর প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম আমদানি হয়েছে ৫৫৭ টন। একই শুল্ক্ক হওয়ার কারণে বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের অনেকেই প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম আমদানি করে আবার রপ্তানি করছে; এতে সরকার বিপুল রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সমকালকে বলেন, দেশে যাতে কাজুবাদামের প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সে জন্য কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি শুল্ক্কমুক্ত করতে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেয়। সম্প্রতি প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানের জন্য কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির ওপর শুল্ক্কহার প্রায় ৯০ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৫-৭ শতাংশে নিয়ে আসতে এনবিআর সম্মত হয়েছে। ভবিষ্যতে এটিকে একদম শুল্ক্কমুক্ত করে দেওয়া হবে। শুধু প্রক্রিয়াজাত নয়, দেশে কাজুবাদাম চাষ জনপ্রিয় করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, এ বছর কৃষকের মধ্যে কাজুবাদামের ৫০ হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া কম্বোডিয়া থেকে প্রায় পাঁচ টন হাইব্রিড কাজুবাদামের বীজ আমদানিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বেসরকারি উদ্যোক্তাকে সহযোগিতা করা হয়েছে। এ বীজের মাধ্যমে প্রায় ছয় লাখ চারা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
- বিষয় :
- বাদামে
- সমৃদ্ধির হাতছানি
- সমৃদ্ধি
- কাজুবাদামে