প্রতিকূলতার মধ্যেও আশা নিয়ে এলো নতুন বছর
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০
নতুন বছর আসে নতুন আশা নিয়ে। এবার নতুন বছর এসেছে ফের করোনা সংক্রমণের নতুন মাত্রার শঙ্কা নিয়ে। সদ্য বিদায়ী বছরটিতে গোটা বিশ্ব করোনো দুর্যোগে বিপর্যস্ত হয়। আমরাও এর বাইরে নই। ইতোমধ্যে করোনার শুধু দ্বিতীয় ঢেউ নয়, নতুন ধরনের করোনা অধিকতর উদ্বিগ্ন করেছে। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে। এই ৫০ বছরের অর্জনের খতিয়ান মূল্যায়ন জরুরি। সদ্য বিদায়ী বছরের শেষের দিকে আমরা দেশে ফের মৌলবাদীদের আস্ম্ফালন দেখেছি। তারা কীভাবে দিনে দিনে এই স্বাধীন বাংলাদেশে বেড়ে উঠেছে, তা সচেতন মানুষ মাত্রই জানা। সামাজিক ক্ষেত্রে অন্যান্য নেতিবাচকতাও কম নয়। তার পরও আশা থেকে যায়। মনে করা হয় যে, দিন বদলাবে। কিন্তু বদলায় না
এবং বদলায় না যে সেই পুরোনো ও একঘেয়ে কাহিনিই নতুন করে বলতে হয়। না বদলাবার কারণ একটি ব্যাধি, যার দ্বারা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র আক্রান্ত। ব্যাধিটির নাম পুঁজিবাদ। এই ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য আমাদের চেষ্টার অবধি নেই। রাজনৈতিকভাবে আমরা বার বার চেষ্টা করেছি; কিন্তু সফল হইনি। মুক্তি যে আসেনি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অতীতে যেমন, সদ্য বিদায়ী বছরেও তেমনটিই লক্ষ্য করা গেছে। মাঝে মধ্যে দু-একটি ঘটনা ঘটে যাতে আমরা ধাক্কা খাই, চমকে উঠি, পরস্পরকে বলি যে, আমরা তো ভালো নেই, কঠিন বিপদের মধ্যে রয়েছি। দেশে আত্মহত্যার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আত্মহত্যা কেউ এমনি এমনি করে না। যন্ত্রণা কেমন দুঃসহ হলে, হতাশা কতটা গভীরে চলে গেলে, নিঃসঙ্গতা কী পরিমাণে বৃদ্ধি পেলে একজন তরুণ বা তরুণী আত্মহত্যা করে, মনে করে যে তার জন্য মৃত্যুই হচ্ছে বাঁচার একমাত্র উপায়, তা বাইরে থেকে বোঝা যাবে না, এমনকি কল্পনা করাও সম্ভব নয়। জানে তা কেবল ভুক্তভোগী। মেয়েরাই আত্মহত্যা করে বেশি, কেননা দুঃখের ঝড়-ঝাপটাগুলো তাদেরই আক্রমণ করে প্রথমে এবং সহজে। খাদ্যের অভাব হলে বনের বাঘ জনপদে চলে আসে। বনের বাঘের জন্য সেটি স্বাভাবিক, কিন্তু মানুষ যখন ক্ষুধার্ত বাঘে পরিণত হয়, তখন সেই অস্বাভাবিকতাটা যে কেমন ভয়ংকর হতে পারে আত্মহত্যা তারই নিদর্শন বটে। কর্মহীন এই বখাটেদের পেছনে সরকারি দলের রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। এরা দলের কাজে লাগে, দলও এদের কাজে লাগায়। দল বদলাতে এদের যে সময় লাগে তাও নয়।
সামাজিক চাপে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধের আইন বিধিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু সে আইনকে যে আরও বিস্তৃত ও শক্ত করা আবশ্যক, মেয়েদের আত্মহত্যার ঘটনা সেই সত্যটাকেই জানিয়ে দেয়। আইনের প্রয়োগকেও কঠোর করা দরকার; সেইসঙ্গে আইনের বিধিগুলোর প্রচার ও সেগুলোর প্রয়োগের দৃষ্টান্ত জনসমক্ষে তুলে ধরাও আবশ্যক। নতুন বছরে আমরা নেতিবাচকতার সব গণ্ডিমুক্ত হব- এই প্রত্যাশা রাখি শত প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও। যে ব্যাধির কারণে নির্যাতন ও আত্মহত্যা ঘটছে, সেটি তো কেবল আইনের পরিধির বিস্তার এবং প্রয়োগের নিশ্চয়তা ও যথার্থতা দিয়ে দূর করা যাবে না, ব্যাধিটিকে উৎপাটিত করা চাই। পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক করে, তাকে ভোগবাদী হতে উৎসাহ দেয়। এর ফলে দুর্বল যাদের অবস্থান সেই ব্যক্তিরা অর্থাৎ দরিদ্র, শিশু ও মেয়েরা- যাদের হাতে বিত্ত ও ক্ষমতা রয়েছে তাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হয়। আমরা স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা অহরহ বলি, কিন্তু সকল মানুষের মুক্তি তো কিছুতেই আসবে না, যদি না পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সেখানে প্রকৃত গণতান্ত্রিক অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা না ঘটাই। মুক্তির জন্য আমরা যে সংগ্রাম করিনি তাও নয়, কিন্তু মুক্তির জন্য সমাজব্যবস্থার অত্যাবশ্যক পরিবর্তনের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চাই না।
ব্যবস্থাটা বদলানো যায়নি, যেজন্য আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। উন্নতি যা ঘটছে তা অল্প কিছু মানুষের, তারাও যে নিরাপদে রয়েছে তা নয়, আর বেশির ভাগ মানুষই কালাতিপাত করছে বিপদের মধ্যে। ব্যক্তিগত চেষ্টায় আমরা এই ব্যবস্থাকে যে বদলাতে পারব না তাতে তো কোনো সন্দেহই নেই। এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েও সেটি অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। হবেও না। প্রয়োজন হলো সমষ্টিগত, ধারাবাহিক এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্যাভিসারী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সেটি না করতে পারলে আমরা বাঁচার মতো বাঁচতে পারব না এবং সবাই আধমরা হয়েই থাকব, এখন যেমনটা রয়েছি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির বলা যায়। করোনা দুর্যোগ এর একটা কারণ। তবে অন্যতম নয়।
ক্রান্তিকাল বলে একটা সময়ের কথা শোনা যায়; ইতিহাসের ধারাপ্রবাহে নানা ক্ষেত্রে ক্রান্তিকাল আসে। আসে শিল্পে, সাহিত্যে, দার্শনিক চিন্তায়, উৎপাদনে ও বিতরণ পদ্ধতির বেলাতে এসে যায়। পুরাতন বিদায় নেয়, নতুনের অভ্যুদয় ঘটে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে আজ তেমনি একটি ক্রান্তিকাল উপস্থিত। আজ প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে নতুন একটি সভ্যতা কি জন্ম নেবে, নাকি পুরাতন সভ্যতা মানুষকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যেতেই থাকবে। কোন পথে এগোবে মানবসভ্যতা; সৃষ্টির নাকি ধ্বংসের? সৃষ্টির পথে এগোতে হলে পুঁজিবাদকে বিদায় করে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে; ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে সামাজিক মালিকানার। হয় এটা, না হয় অপরটা, মাঝখানে কিছু নেই। সমঝোতা কালক্ষেপণের চেষ্টা হবে মাত্র। সৃষ্টির পথে না এগোলে ধ্বংসের তৎপরতা আরও নিষ্ঠুর ও সর্বগ্রাসী হয়ে উঠবে। উদারনীতিকে এক সময়ে প্রগতিশীল মনে করা হতো। সেকাল এখন আর নেই। রাজনীতিতে মেরুকরণ অনিবার্য হয়ে পড়ছে। বার্নি স্যান্ডার্স ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতর থেকেই কাজ করবেন ভেবেছিলেন; চেষ্টাও করলেন; কিছুটা সফলতাও পেলেন, কিন্তু তা সামান্যই। আগামীতে তাকে এবং তার মতো ঘোষিত সমাজতন্ত্রীদের পক্ষে নিজেদের পার্টি গঠন ছাড়া এগোবার উপায় থাকবে না।
গ্রেট ব্রিটেনের লেবার পার্টির প্রধান জেরেমি করবিন প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলেন, টনি ব্লেয়াররা ওই পার্টিকে রক্ষণশীলতার যে দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে সমাজতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারেননি। উল্টো তিনি নিজেই অপসারিত হয়ে গেছেন। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় সকলের জন্য যে সমান অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন, তা কখনোই অর্জন করা সম্ভব হবে না। সেটি অর্জনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবের, যে বিপ্লব পুঁজিবাদকে বিদায় করে দিয়ে নতুন এক সভ্যতার জন্মকে সম্ভবপর করে তুলবে। আর নির্বাচন? হ্যাঁ হবে, কিন্তু ক্ষমতা সেখানেই রয়ে যাবে যেখানে ছিল- শ্রেণিগতভাবেই শুধু নয়, একেবারে দলীয়ভাবেই, এমন ঘটনা তো হরদমই ঘটছে। সদ্য বিদায়ী বছরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি ছিল আলোচিত ঘটনা। নির্বাচিত জো বাইডেন পরাজিত ট্রাম্পকে শেষ পর্যন্ত সরাতে পারবেন, হোয়াইট হাউস তার দখলে আসেবে, কিন্তু তিনিও তো সেই জাতীয়তাবাদীই। ট্রাম্প বলতেন আমেরিকা ফার্স্ট, বাইডেন বলছেন আমেরিকা ইজ ব্যাক। দু'জনই আমেরিকার পক্ষে, আর তাদের আমেরিকা পুঁজিবাদীই, অন্যকিছু নয়।
করোনাভাইরাসের দূত পাঠিয়ে পুঁজিবাদ জানিয়ে দিয়েছে যে, সারাবিশ্বের মানুষের ওপরই মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি হয়ে হয়েছে; বিশ্ববাসী পারলে এখন বাঁচবে, নয় তো মরবে। বিশ্বের মানুষ নিশ্চয়ই মরতে রাজি হবে না। নতুন বছর শুরু হয়েছে। নানা প্রত্যাশা আর স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষা প্রতি নতুন বছরের আগমনে আমরা করে থাকি। এবারের নতুন বছরেও আমরা তেমন প্রত্যাশা করছি বৈকি। তবে দেশের সার্বিক অবস্থা আমাদের শঙ্কিত করে তুলেছে। দেশে ধর্ষণ আগেও ছিল, কিন্তু এখন তা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পাঁচ-সাত বছরের শিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। গণধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। সহিংসতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানিরা যা করেছে তা ছিল শত্রুপক্ষের কাজ, এখন দেশের মানুষ নিজেরাই স্বদেশিদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
সমাজের সর্বত্র চলছে হীন প্রতিযোগিতা। কে কাকে ডিঙিয়ে এগিয়ে যাবে, কাকে ধাক্কা দিলে নিজের অর্জন নিশ্চিত হবে- সেটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান ঘটনা। ব্যক্তির উন্নতির এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সমষ্টি ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, যা নির্বাচনের মাধ্যমে আসবে না, আসবে সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের পথে। আমরা এমন ব্যবস্থা চাই, যা মানুষকে আশাহীন এবং ভবিষ্যৎহীন করবে না, সকলের জন্য অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করবে। সে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ছাড়া আমাদের পরিত্রাণ নেই। এটা বললে অন্যায় হবে না যে, যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলি, আসলে তা ছিল সমাজবিপ্লবেরই চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সেই বাংলাদেশে ফিরে যাওয়াই হোক নতুন বছরের প্রত্যয়। নতুন বছর অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও আশা নিয়েই এসেছে। এই আশা দুরাশায় পরিণত না হলেই মঙ্গল।
এবং বদলায় না যে সেই পুরোনো ও একঘেয়ে কাহিনিই নতুন করে বলতে হয়। না বদলাবার কারণ একটি ব্যাধি, যার দ্বারা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র আক্রান্ত। ব্যাধিটির নাম পুঁজিবাদ। এই ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য আমাদের চেষ্টার অবধি নেই। রাজনৈতিকভাবে আমরা বার বার চেষ্টা করেছি; কিন্তু সফল হইনি। মুক্তি যে আসেনি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অতীতে যেমন, সদ্য বিদায়ী বছরেও তেমনটিই লক্ষ্য করা গেছে। মাঝে মধ্যে দু-একটি ঘটনা ঘটে যাতে আমরা ধাক্কা খাই, চমকে উঠি, পরস্পরকে বলি যে, আমরা তো ভালো নেই, কঠিন বিপদের মধ্যে রয়েছি। দেশে আত্মহত্যার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আত্মহত্যা কেউ এমনি এমনি করে না। যন্ত্রণা কেমন দুঃসহ হলে, হতাশা কতটা গভীরে চলে গেলে, নিঃসঙ্গতা কী পরিমাণে বৃদ্ধি পেলে একজন তরুণ বা তরুণী আত্মহত্যা করে, মনে করে যে তার জন্য মৃত্যুই হচ্ছে বাঁচার একমাত্র উপায়, তা বাইরে থেকে বোঝা যাবে না, এমনকি কল্পনা করাও সম্ভব নয়। জানে তা কেবল ভুক্তভোগী। মেয়েরাই আত্মহত্যা করে বেশি, কেননা দুঃখের ঝড়-ঝাপটাগুলো তাদেরই আক্রমণ করে প্রথমে এবং সহজে। খাদ্যের অভাব হলে বনের বাঘ জনপদে চলে আসে। বনের বাঘের জন্য সেটি স্বাভাবিক, কিন্তু মানুষ যখন ক্ষুধার্ত বাঘে পরিণত হয়, তখন সেই অস্বাভাবিকতাটা যে কেমন ভয়ংকর হতে পারে আত্মহত্যা তারই নিদর্শন বটে। কর্মহীন এই বখাটেদের পেছনে সরকারি দলের রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। এরা দলের কাজে লাগে, দলও এদের কাজে লাগায়। দল বদলাতে এদের যে সময় লাগে তাও নয়।
সামাজিক চাপে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধের আইন বিধিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু সে আইনকে যে আরও বিস্তৃত ও শক্ত করা আবশ্যক, মেয়েদের আত্মহত্যার ঘটনা সেই সত্যটাকেই জানিয়ে দেয়। আইনের প্রয়োগকেও কঠোর করা দরকার; সেইসঙ্গে আইনের বিধিগুলোর প্রচার ও সেগুলোর প্রয়োগের দৃষ্টান্ত জনসমক্ষে তুলে ধরাও আবশ্যক। নতুন বছরে আমরা নেতিবাচকতার সব গণ্ডিমুক্ত হব- এই প্রত্যাশা রাখি শত প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও। যে ব্যাধির কারণে নির্যাতন ও আত্মহত্যা ঘটছে, সেটি তো কেবল আইনের পরিধির বিস্তার এবং প্রয়োগের নিশ্চয়তা ও যথার্থতা দিয়ে দূর করা যাবে না, ব্যাধিটিকে উৎপাটিত করা চাই। পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক করে, তাকে ভোগবাদী হতে উৎসাহ দেয়। এর ফলে দুর্বল যাদের অবস্থান সেই ব্যক্তিরা অর্থাৎ দরিদ্র, শিশু ও মেয়েরা- যাদের হাতে বিত্ত ও ক্ষমতা রয়েছে তাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হয়। আমরা স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা অহরহ বলি, কিন্তু সকল মানুষের মুক্তি তো কিছুতেই আসবে না, যদি না পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সেখানে প্রকৃত গণতান্ত্রিক অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা না ঘটাই। মুক্তির জন্য আমরা যে সংগ্রাম করিনি তাও নয়, কিন্তু মুক্তির জন্য সমাজব্যবস্থার অত্যাবশ্যক পরিবর্তনের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চাই না।
ব্যবস্থাটা বদলানো যায়নি, যেজন্য আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। উন্নতি যা ঘটছে তা অল্প কিছু মানুষের, তারাও যে নিরাপদে রয়েছে তা নয়, আর বেশির ভাগ মানুষই কালাতিপাত করছে বিপদের মধ্যে। ব্যক্তিগত চেষ্টায় আমরা এই ব্যবস্থাকে যে বদলাতে পারব না তাতে তো কোনো সন্দেহই নেই। এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েও সেটি অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। হবেও না। প্রয়োজন হলো সমষ্টিগত, ধারাবাহিক এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্যাভিসারী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সেটি না করতে পারলে আমরা বাঁচার মতো বাঁচতে পারব না এবং সবাই আধমরা হয়েই থাকব, এখন যেমনটা রয়েছি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির বলা যায়। করোনা দুর্যোগ এর একটা কারণ। তবে অন্যতম নয়।
ক্রান্তিকাল বলে একটা সময়ের কথা শোনা যায়; ইতিহাসের ধারাপ্রবাহে নানা ক্ষেত্রে ক্রান্তিকাল আসে। আসে শিল্পে, সাহিত্যে, দার্শনিক চিন্তায়, উৎপাদনে ও বিতরণ পদ্ধতির বেলাতে এসে যায়। পুরাতন বিদায় নেয়, নতুনের অভ্যুদয় ঘটে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে আজ তেমনি একটি ক্রান্তিকাল উপস্থিত। আজ প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে নতুন একটি সভ্যতা কি জন্ম নেবে, নাকি পুরাতন সভ্যতা মানুষকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যেতেই থাকবে। কোন পথে এগোবে মানবসভ্যতা; সৃষ্টির নাকি ধ্বংসের? সৃষ্টির পথে এগোতে হলে পুঁজিবাদকে বিদায় করে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে; ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে সামাজিক মালিকানার। হয় এটা, না হয় অপরটা, মাঝখানে কিছু নেই। সমঝোতা কালক্ষেপণের চেষ্টা হবে মাত্র। সৃষ্টির পথে না এগোলে ধ্বংসের তৎপরতা আরও নিষ্ঠুর ও সর্বগ্রাসী হয়ে উঠবে। উদারনীতিকে এক সময়ে প্রগতিশীল মনে করা হতো। সেকাল এখন আর নেই। রাজনীতিতে মেরুকরণ অনিবার্য হয়ে পড়ছে। বার্নি স্যান্ডার্স ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতর থেকেই কাজ করবেন ভেবেছিলেন; চেষ্টাও করলেন; কিছুটা সফলতাও পেলেন, কিন্তু তা সামান্যই। আগামীতে তাকে এবং তার মতো ঘোষিত সমাজতন্ত্রীদের পক্ষে নিজেদের পার্টি গঠন ছাড়া এগোবার উপায় থাকবে না।
গ্রেট ব্রিটেনের লেবার পার্টির প্রধান জেরেমি করবিন প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলেন, টনি ব্লেয়াররা ওই পার্টিকে রক্ষণশীলতার যে দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে সমাজতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারেননি। উল্টো তিনি নিজেই অপসারিত হয়ে গেছেন। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় সকলের জন্য যে সমান অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন, তা কখনোই অর্জন করা সম্ভব হবে না। সেটি অর্জনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবের, যে বিপ্লব পুঁজিবাদকে বিদায় করে দিয়ে নতুন এক সভ্যতার জন্মকে সম্ভবপর করে তুলবে। আর নির্বাচন? হ্যাঁ হবে, কিন্তু ক্ষমতা সেখানেই রয়ে যাবে যেখানে ছিল- শ্রেণিগতভাবেই শুধু নয়, একেবারে দলীয়ভাবেই, এমন ঘটনা তো হরদমই ঘটছে। সদ্য বিদায়ী বছরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি ছিল আলোচিত ঘটনা। নির্বাচিত জো বাইডেন পরাজিত ট্রাম্পকে শেষ পর্যন্ত সরাতে পারবেন, হোয়াইট হাউস তার দখলে আসেবে, কিন্তু তিনিও তো সেই জাতীয়তাবাদীই। ট্রাম্প বলতেন আমেরিকা ফার্স্ট, বাইডেন বলছেন আমেরিকা ইজ ব্যাক। দু'জনই আমেরিকার পক্ষে, আর তাদের আমেরিকা পুঁজিবাদীই, অন্যকিছু নয়।
করোনাভাইরাসের দূত পাঠিয়ে পুঁজিবাদ জানিয়ে দিয়েছে যে, সারাবিশ্বের মানুষের ওপরই মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি হয়ে হয়েছে; বিশ্ববাসী পারলে এখন বাঁচবে, নয় তো মরবে। বিশ্বের মানুষ নিশ্চয়ই মরতে রাজি হবে না। নতুন বছর শুরু হয়েছে। নানা প্রত্যাশা আর স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষা প্রতি নতুন বছরের আগমনে আমরা করে থাকি। এবারের নতুন বছরেও আমরা তেমন প্রত্যাশা করছি বৈকি। তবে দেশের সার্বিক অবস্থা আমাদের শঙ্কিত করে তুলেছে। দেশে ধর্ষণ আগেও ছিল, কিন্তু এখন তা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পাঁচ-সাত বছরের শিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। গণধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। সহিংসতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানিরা যা করেছে তা ছিল শত্রুপক্ষের কাজ, এখন দেশের মানুষ নিজেরাই স্বদেশিদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
সমাজের সর্বত্র চলছে হীন প্রতিযোগিতা। কে কাকে ডিঙিয়ে এগিয়ে যাবে, কাকে ধাক্কা দিলে নিজের অর্জন নিশ্চিত হবে- সেটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান ঘটনা। ব্যক্তির উন্নতির এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সমষ্টি ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, যা নির্বাচনের মাধ্যমে আসবে না, আসবে সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের পথে। আমরা এমন ব্যবস্থা চাই, যা মানুষকে আশাহীন এবং ভবিষ্যৎহীন করবে না, সকলের জন্য অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করবে। সে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ছাড়া আমাদের পরিত্রাণ নেই। এটা বললে অন্যায় হবে না যে, যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলি, আসলে তা ছিল সমাজবিপ্লবেরই চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সেই বাংলাদেশে ফিরে যাওয়াই হোক নতুন বছরের প্রত্যয়। নতুন বছর অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও আশা নিয়েই এসেছে। এই আশা দুরাশায় পরিণত না হলেই মঙ্গল।